
পাঁচ চ্যালেঞ্জের মুখে চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ (পয়োনিষ্কাশন) প্রকল্প। রাস্তা কর্তনে চসিকের সীমিত আকারে অনুমতি প্রদান, চাহিদার তুলনায় মন্ত্রণালয়ের কম অর্থ ছাড়, নগরীর কিছু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সরু রাস্তার কারণে পাইপলাইন স্থাপনে ধীরগতি, বে-টার্মিনালে পাশে চ্যানেল নির্মাণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিলম্ব ও হালিশহর বড়পুল চৌ-চালা সড়কের পাশে প্রকল্পের প্রধান ট্রাঙ্কলাইন স্থাপনের জন্য অস্থায়ীভাবে ভূমি ব্যবহারে রেলের সিদ্ধান্ত জানাতে বিলম্বের কারণে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এতে কাজের গতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্যুয়ারেজ প্রকল্পের পাঁচ চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পয়োপাইপলাইন বসানো। নগরীর সড়ক কেটে এসব পাইপলাইন বসানো হয়। এজন্য সড়ক কাটার আগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) থেকে অনুমতি নিতে হয় ওয়াসাকে। তাছাড়া বর্ষা মওসুমের কারণে গত জুন থেকে চলতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ মাস রাস্তা কর্তনের অনুমতি সীমিত করে চসিক। এ কারণে পয়োপাইপলাইন বসানো কাজের গতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাচ্ছে না। সড়ক কাটার অনুমতি বিলম্ব ও সীমিত করার কারণে বর্তমানে পাইপলাইন বসানোর কাজ চলছে সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ।
স্যুয়ারেজ প্রকল্পের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- সরকারি অর্থ বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় কম। চলতি অর্থ বছরে সরকার থেকে অর্থ বরাদ্দ মেলেছে মাত্র ৬২৬ কোটি টাকা মাত্র। তাই প্রকল্পের কাজের গতি ধারাবাহিকতায় রক্ষায় আরো ৪০০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ করেছে প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটি। এটি এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রকল্পের তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- প্রকল্প এলাকা নগরীর আগ্রাবাদ মুহুরীপাড়া, রঙ্গিপাড়া, বেপারিপাড়া, পাঠানটুলী, গোসাইলডাঙ্গা, মাদারবাড়িসহ প্রভৃতি এলাকা একে তো ঘনবসতি এবং সরু রাস্তা। এ কারণে পাইপলাইন বসানোর কাজে যন্ত্রপাতি পরিবহন কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়াও সরু রাস্তার কারণে পথচারীদের চলাচলের সুবিধা বিবেচনা করে পাইপলাইন বসানোর কাজ করতে হচ্ছে। এ কারণে পূর্ণ সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করা যাচ্ছে না।
চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- হালিশহরে ট্রিটমেন্ট প্রকল্প এলাকায় সাগর সংলগ্ন বে-টার্মিনালের পাশে একটি চ্যানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের। পয়োবর্জ্য পরিশোধনের পর পরিষ্কার পানি এ চ্যানেল দিয়ে সাগরে ফেলা হবে। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ এখনো চ্যানেল নির্মাণের কাজ শুরু করেনি বলে অভিযোগ করেছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০২৭ সালে চ্যানেলটি নির্মাণ করবে বলে জানা গেছে। অথচ স্যুয়ারেজ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৬ সালে। এ কারণে চ্যানেল নির্মাণ বিলম্ব হলে বেকায়দা পড়বে স্যুয়ারেজ প্রকল্প।
সর্বশেষ স্যুয়ারেজ প্রকল্পের পঞ্চম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- প্রকল্পের প্রধান ট্রাঙ্কলাইন স্থাপনের জন্য ট্রাফিক ডাইভারশন ও বিদ্যুৎলাইন অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরের জন্য রেলওয়ের কাছে হালিশহরের বড়পুল চৌচালা সড়কের কিছু অংশ সাময়িক ব্যবহারের জন্য রেলের কাছে চিঠি দিয়েছে ওয়াসা। দীর্ঘ ১১ মাসেও রেলের কাছ থেকে অনুমতি পায়নি ওয়াসা। এতে কাজের গতি বাড়ানো যাচ্ছে না স্যুয়ারেজ প্রকল্পের।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম ওয়াসার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ‘স্যুয়ারেজ’। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ওয়াসার স্যুয়ারেজের প্রথম প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ অর্থায়নে প্রকল্পের জন্য প্রথমবার ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন হাজার ৮০৮ কোটি ৫৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। কিন্তু পরে প্রকল্পটি সংশোধিত প্রস্তাব চলতি বছরের ২০ এপ্রিল একনেক সভায় অনুমোদন হলে ব্যয় বাড়ে আরো এক হাজার ৪১০ কোটি টাকা। তাতে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৫ হাজার ২১৯ কোটি টাকা।
বর্তমানে দুইভাগে চলছে প্রকল্পের কাজ। একটি হচ্ছে- পাইপলাইন বসানো এবং অপরটি হালিশহরে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ। প্রকল্পের অধীনে সবমিলে পয়োপাইপলাইন বসানো হবে ২০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৮১ কিলোমিটার অগভীর পাইপলাইন। বর্তমানে অগভীর পাইপলাইন বসানো হয়েছে ৯৭ কিলোমিটার। এসব পাইপলাইন সর্বোচ্চ ৪ মিটার মাটির গভীরে বসানো হচ্ছে। অপর ১৯ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো হচ্ছে সর্বনি¤œ ৬ মিটার থেকে সর্বোচ্চ ১৪ মিটার মাটির গভীরে। প্রকল্পের অধীনে বর্তমানে গভীর পাইপলাইন বসানো হয়েছে ৯ কিলোমিটার। সবমিলে বিভিন্ন সাইজের পাইপলাইন বসানো হয়েছে ১০৬ কিলোমিটার। এতে পাইপলাইনের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৫০ শতাংশ।
অপরদিকে হালিশহরে প্রকল্প এলাকায় পয়োশোধনাগার, ফিক্যাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট (মানুষের মল পরিশোধনাগার) প্ল্যান্ট নির্মাণে সিভিলের কাজ শেষ হয়েছে ৮৫ শতাংশ এবং ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল কাজ হয়েছে ৪০ শতাংশ। এছাড়া প্রকল্পের অধীনে গৃহ পয়োসংযোগ হবে ২৮ হাজার। বর্তমানে সংযোগ প্রদান করা হয়েছে ১২ হাজার গৃহে। সবমিলে স্যুয়ারেজের প্রথম প্রকল্পের এ পর্যন্ত ৬৯ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আগামী ২০২৬ সালে প্রকল্প শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে ওয়াসার।
ওয়াসা সূত্র জানায়, দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিকাদার সংস্থা তায়ং ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এ প্রকল্পের কাজ করছে। একইসাথে চলছে গ্রাহক পর্যায়ে পয়োসংযোগ লাইন প্রদানের কাজও। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর নগরীর ২০ লাখ মানুষ স্যুয়ারেজের আওতায় আসবে। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম ওয়াসার এটিই হচ্ছে প্রথম স্যুয়ারেজ প্রকল্প।
ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্প পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, ‘পাঁচ চ্যালেঞ্জের কারণে স্যুয়ারেজ প্রকল্পের গতি বাড়ানো যাচ্ছে না। তারপরও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সাথে সমন্বয় করে গতি বাড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে প্রকল্পের ৬৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব চলতি বছরের ২০ এপ্রিল একনেক সভায় অনুমোদন হলে ব্যয় বাড়ে আরো এক হাজার ৪১০ কোটি টাকা। তাতে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২১৯ কোটি টাকা।
ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম পূর্বকোণকে বলেন, ‘স্যুয়ারেজ প্রকল্পের অন্যতম কাজ হচ্ছে পয়োপাইপলাইন বসানো। নগরীর সড়কগুলোতে বসানো হয় পাইপলাইন। এজন্য চসিক থেকে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু যথাসময়ে অনুমতি না পেলে কাজের গতি বাড়ানো যায় না। তাই কাজের গতি বাড়াতে ওয়াসা ও চসিক মিলে একটি যৌথ কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করি এ কমিটির মাধ্যমে কাজের গতি বাড়ানো সম্ভব হবে।’
সড়ক কর্তন নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘বর্ষা মওসুমশেষে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ৭০টি সড়কে উন্নয়ন ও সংস্কারের কাজ করবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। তাই রাস্তা কাটার ব্যাপারে সমন্বয় করতে চসিক ও ওয়াসা একটি যৌথ কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাস্তা কর্তনের অনুমতি দিবে চসিক।’
পূর্বকোণ/ইবনুর