
#তু হিন্দু বানেগা না মুসলমান বানেগা,
(তুই হিন্দু বা মুসলমান হবি না)
ইনসান কি আওলাদ হায় তু ইনসান বানেগা।
(মানুষের সন্তান তুই মানুষই হবি)
আচ্ছা হায়, আভি তক তেরা কুছ নাম নাহি,
(এটাই ভাল, তোর এখনও পর্যন্ত কোন নাম নেই)
তুঝকো কিসিসে মাজহাব সে কোই কাম নেহি,
(কোন জাত-পাত-ধর্ম নিয়ে তোর কোন মাথাব্যথা নেই)
মালিক নে হার ইনসান কো ইনসান বানায়া,
(খোদা প্রতিটা মানুষকে মানুষই বানিয়েছেন)
হাম নে উসি হিন্দু ইয়া মুসলমান বানায়া।
(আমরাই সেই মানুষকে হিন্দু কিংবা মুসলমান বানিয়েছি/ভেদাভেদ করেছি)
কুদরত নে তু হামে বাকশি হি এক ধারতি,
(প্রকৃতি আমাদেরকে একই পৃথিবী দিয়েছে)
হামনে কাহি ভারত কাহি ইরান বানায়া,
(আমরাই তার কোথাও ভারত কোথাও ইরান বানিয়েছি)
জো তোড়তে হার সাং ও তুফান বানেগা,
(যে তুফান সব বাধা ভেঙ্গে দেয়, তুই সে তুফান হবি)
ইনসান কি আওলাদ হায় তু ইনসান বানেগা।
(মানুষের সন্তান তুই মানুষই হবি)
নাফরাত ওয়া সিখায়ে ও ধরম তেরা নাহি হায়,
(যে ধর্ম ঘৃণা শেখায়, সে ধর্ম তোর নয়)
ইনসান কোন জো রণ্ডে ও কদম তেরা নেহি হায়,
(যে পা মানুষকে/মানবতাকে পদদলিত করে, সেই পা তোর নয়)
কুরআন না হো জিসমি ওয়া মান্দির নাহি তেরা,
(যে মন্দিরে কুরআন নেই, সে মন্দির তোর নয়)
গীতা না হো জিসমে ও হারাম তেরা নাহি হায়,
(যে মসজিদে গীতা নেই, সেও তোর নয়)
তু হিন্দু বানেগা না মুসলমান বানেগা,
(তুই হিন্দু বা মুসলমান হবি না)
ইনসান কি আওলাদ হায় তু ইনসান বানেগা।
(মানুষের সন্তান তুই মানুষই হবি)
গানটির মূল শিক্ষা অনুধাবন করে লাইন-বাই-লাইন সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করার ক্ষুদ্র প্রয়াসঃ
১.“তু হিন্দু বানেগা না মুসলমান বানেগা, ইনসান কি আওলাদ হায় তু ইনসান বানেগা।”
(তুই হিন্দু বা মুসলমান হবি না, মানুষের সন্তান তুই মানুষই হবি)
কুরআন: يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
“হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, এবং তোমাদেরকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যেন তোমরা পরস্পর পরিচিত হও। আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ, যে সর্বাধিক তাকওয়াবান।” (সুরা হুজুরাত ৪৯:১৩)
সুফী ভাবনা: ইবনে আরাবি (রহ.) বলেন —
“মানুষই হলো আল্লাহর আয়না। যে মানুষের মধ্যে তাকায়, সে আসলে আল্লাহর নূরকেই দেখে।”
এখানে বার্তা হলো: মানুষের আসল পরিচয় তার ধর্মীয় লেবেল নয়, বরং সে “আদম সন্তান” এবং আল্লাহর প্রতিনিধি।
২.“আচ্ছা হায় আভি তক তেরা কুছ নাম নাহি, তুঝকো কিসিসে মাজহাব সে কোই কাম নেহি।”
(এটাই ভালো, তোর এখনও নাম নেই; কোনো ধর্মের সঙ্গে তোর মাথাব্যথা নেই)।
রাসূল ﷺ বলেছেন: كل مولود يولد على الفطر
“প্রত্যেক শিশু ফিতরাতের (শুদ্ধ প্রকৃতি) উপর জন্মগ্রহণ করে।” (বুখারি, মুসলিম)
সুফী দৃষ্টিভঙ্গি: রুমি (রহ.) বলেছেন —
“শিশুর হৃদয় কাগজের মতো, যেখানে সমাজ তার ধর্ম, সংস্কার ও বিভেদ লিখে দেয়।”
এর মানে জন্মের সময় শিশু নির্দোষ ও পবিত্র, ধর্মীয় বিভেদ তখনো তার জীবনে আসে না।
৩️.“মালিক নে হার ইনসান কো ইনসান বানায়া, হাম নে উসি হিন্দু ইয়া মুসলমান বানায়া।”
(খোদা প্রতিটি মানুষকে মানুষ বানিয়েছেন, আমরা-ই তাকে হিন্দু-মুসলমান করেছি)
কুরআন: فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا
“এটি আল্লাহর ফিতরাত (প্রকৃতি), যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা রূম ৩০:৩০)
ইমাম গাজ্জালী (রহ.):
“ধর্ম হলো আল্লাহর সাথে সম্পর্ক, কিন্তু মানুষ নিজের স্বার্থে তাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক লেবেল বানিয়েছে।”
বিভেদ সৃষ্টির দায় মানুষের, আল্লাহর নয়।
৪️.“কুদরত নে তু হামে বাকশি হি এক ধারতি, হামনে কাহি ভারত কাহি ইরান বানায়া।”
(প্রকৃতি আমাদের এক পৃথিবী দিয়েছে, আমরা-ই
ভারত-ইরান ভাগ করেছি)
কুরআন: وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ بِسَاطًا
“আল্লাহ তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা করেছেন।” (সুরা নূহ ৭১:১৯)
সুফী দার্শনিক ইকবাল (রহ.):
“পৃথিবী আল্লাহর, সীমান্ত মানুষ তৈরি করেছে; মুসলমানের জন্য পুরো দুনিয়াই একটি মসজিদ।”
বিভক্তি ও জাতীয়তার সংকীর্ণতা মানুষের সৃষ্টি, আল্লাহর নয়।
৫.“জো তোড়তে হার সাং ও তুফান বানেগা, ইনসান কি আওলাদ হায় তু ইনসান বানেগা।”
(যে তুফান সব বাধা ভাঙে, তুই সেই তুফান হবি; মানুষের সন্তান তুই মানুষই হবি)
কুরআন: إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের পরিবর্তন করে।” (সুরা রা’দ ১৩:১১)
রুমি (রহ.):
“মানবতার পথে দাঁড়ানো প্রতিটি প্রাচীর ভাঙা একজন ইনসানের দায়িত্ব।”
প্রকৃত মানুষ হতে হলে বিভেদের প্রাচীর ভাঙতে হবে।
৬️.“নাফরাত ওয়া সিখায়ে ও ধরম তেরা নাহি হায়, ইনসান কোন জো রণ্ডে ও কদম তেরা নেহি হায়।”
(যে ধর্ম ঘৃণা শেখায় তা তোর নয়; যে পদক্ষেপ মানুষকে পদদলিত করে, তা তোর নয়)
হাদিস: المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
“প্রকৃত মুসলমান সে-ই, যার জবান ও হাত থেকে মানুষ নিরাপদ থাকে।” (বুখারি, মুসলিম)
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.):
“ধর্ম হলো ভালোবাসা ও সেবার নাম, ঘৃণা ও বৈরিতার নয়।”
প্রকৃত ধর্ম কখনো ঘৃণা বা হিংসা শেখায় না।
“কুরআন না হো জিসমি ওয়া মান্দির নাহি তেরা, গীতা না হো জিসমে ও হারাম তেরা নাহি হায়।”
(যে মন্দিরে কুরআন নেই তা তোর নয়, যে মসজিদে গীতা নেই সেও তোর নয়)
ইবনে আরাবি (রহ.):
“আমার হৃদয় মসজিদও, মন্দিরও, কাবাও, তাওরাতের পাতাও, কুরআনের আয়াতও। আমি সেই ধর্ম অনুসরণ করি, যেখানে ভালোবাসা আছে।”
কুরআন: فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ
“তোমরা যেদিকেই ফির, সেদিকেই আল্লাহর মুখ।” (সুরা বাকারা ২:১১৫)
প্রকৃত উপাসনালয় মানুষের হৃদয়; যেখানে ভালোবাসা আছে, সেখানেই আল্লাহর উপস্থিতি।
কবি নজরুল;
মসজিদ এই মন্দির এই গীর্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈসা- মুছা পেল সত্যের পরিচয়,
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন কাবা মন্দির নাই।
পরিশেষে, (সমস্ত গানের সংহতি)
১. মানুষ জন্মগতভাবে নির্দোষ ও এক, বিভাজন পরে সমাজ তৈরি করে।
২. আল্লাহর কাছে মানুষের আসল পরিচয় “ইনসান” হওয়া, জাতি-ধর্ম নয়।
৩. ধর্মের মূল শিক্ষা হলো ভালোবাসা, মানবসেবা ও ঐক্য।
৪. বিভেদ, ঘৃণা, সীমানা—এসব মানুষের তৈরি, আল্লাহর নয়।
৫. প্রকৃত ইনসান সেই, যে আল্লাহর ভালোবাসাকে মানুষের হৃদয়ে প্রতিফলিত করে।
৬. ইনসানে কামেল হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিফলন ঘটান, মানবতার কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেন এবং আল্লাহর নৈকট্যের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দুনিয়া ও আখিরাতে আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠেন।
এই গানের মূলভাব হচ্ছে– মানুষকে ধর্ম, জাতি,বর্ণ নির্বিশেষে ভৌগোলিক সীমানা, ভেদাভেদ ইত্যাদির বাইরে গিয়ে শুদ্ধ মানবতার ভিত্তিতে দেখা। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু মানুষ নিজেরাই হিন্দু-মুসলিম, ভারত-ইরান ইত্যাদি ভাগ করেছে। প্রকৃত ধর্ম কোনো ঘৃণা শেখায় না, বরং এক, একক, অদ্বিতীয় শ্রষ্টা বিশ্বাসে ভালোবাসা ও ঐক্যৈর ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সম্প্রীতিময় সহাবস্থান শেখায়।
পূর্বকোণ/এএইচ