চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

ক্যান্টিনের গণ্ডি পেরিয়ে আবারও আলোয় চাকসু

ক্যান্টিনের গণ্ডি পেরিয়ে আবারও আলোয় চাকসু

৩৫ বছর ধরে চাকসুকে ক্যান্টিন হিসেবেই চিনে আসছিল শিক্ষার্থীরা

তাসনীম হাসান

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ১২:০২ অপরাহ্ণ

২০২২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ইসরাত জাহান তানিয়া। এরপর ক্লাসের ফাঁকে তাঁর বহুবার যাওয়া হয়েছে চবি কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (চাকসু) ভবনে। প্রতিবারই গিয়েছেন হয় নাশতা করতে না হয় দুপুরের খাবার খেতে।

ক্যাম্পাসে প্রায় তিন বছর কাটিয়ে দেওয়া তানিয়া কদিন আগেও তিনতলার চাকসু ভবনটিকে চিনতেন ‘ক্যান্টিন’ হিসেবেই। তানিয়া একা নন, বিশ^বিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষার্থীই সাদা ভবনটিকে চিনে এসেছেন এই পরিচয়েই। কেননা সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের ঠুকঠাক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনেই যে সীমাবদ্ধ ছিল এই ভবনের পরিচয়। অথচ এ ভবনের প্রতিটি ইটের ভেতরেই লুকিয়ে আছে ছাত্র রাজনীতির এক উজ্জ্বল ইতিহাস।

 

পয়ত্রিশ বছরের দীর্ঘ বিরতির পর অবশেষে সেই হারানো পরিচয় ফিরে পেতে শুরু করেছে চাকসু। আগামী ১২ অক্টোবর হবে এই সংসদ ও হল সংসদের বহুল কাক্সিক্ষত ভোট। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে মনোনয়নপত্র বিতরণও।

 

৩৫ বছর বন্ধ ছিল নির্বাচন: ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই গঠিত হয় চাকসু। শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীদের মানসিক সংস্কৃতির বিকাশ, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ ও রাষ্ট্রের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখাই ছিল এর লক্ষ্য। প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে। এরপর ১৯৭১, ১৯৭৩ ও ১৯৮০ সালে হয় তিনটি নির্বাচন। সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ১৯৯০ সালে ছাত্র ঐক্য নেতা ফারুকুজ্জামান নিহত হওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয় চাকসু নির্বাচন। এরপর অকেজো হয়ে পড়েছিল ছাত্র-ছাত্রীদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া চর্চার প্রাণকেন্দ্রটি।

 

চাকসু হারিয়েছিল তার পরিচয়: যে চাকসু ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলো থেকে শুরু করে দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় থেকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন না হওয়ায় সেই চাকসুই তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ছিল অকার্যকর। এই সময়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন, তাদের কাছে চাকসুর গল্প ছিল কেবল স্মৃতির ঝাঁপি থেকে শোনা এক ইতিহাস। বাস্তবে তারা পেয়েছেন এক অচল সংসদ, নিথর ভবন, আর ক্যান্টিনের গণ্ডিতে আটকে থাকা এক নামমাত্র প্রতিষ্ঠান।
কেননা ভবনটিতে ছাত্র সংসদের কার্যালয় থাকলেও এটি ক্যান্টিন আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এক যুগ আগে এখানকার কক্ষগুলো ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালন করতে আসা পুলিশ সদস্যদের থাকার জন্যও বরাদ্দ দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালে এই ভবনে কর্মচারী সমিতির নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা এই বছরের ৩০ জুন বিদ্রুপ করে চাকসু ভবনের নামফলকের ওপরে ‘জোবরা ভাতের হোটেল ও কমিউনিটি সেন্টার’-নামে ব্যানার টানিয়ে দেন।

 

প্রতীক্ষার অবসান: আওয়ামী লীগের সাড়ে পনেরো বছরের শাসনামলে সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র একবারই ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল, ২০১৯ সালের ১১ মার্চ। সেই নির্বাচন ঘিরেও ছিল নানা বিতর্ক, নানা প্রশ্ন। ডাকসু নির্বাচনের পর চবির শিক্ষার্থীরাও চাকসু নির্বাচনের দাবি জানান। তাঁদের দাবির মুখে ওই বছরের ২০ মার্চ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। চাকসুর নীতিমালা পর্যালোচনা করতে পাঁচ সদস্যের কমিটিও হয়েছিল। কিন্তু এরপর আলোর মুখ দেখেনি নির্বাচন। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে দেশের ছাত্রসংসদগুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার হচ্ছে চাকসু নির্বাচন। গত রবিবার থেকে শুরু হয়েছে মনোনয়নপত্র বিতরণও। নির্বাচনকে ঘিরে এর মধ্যেই ক্যাম্পাসজুড়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উচ্ছ্বাস, প্রত্যাশা আর কৌতূহলের ঢেউ।

 

স্যার এফ রহমান হল সংসদে সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন মোহাম্মদ হুসাইন। বিশ^বিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের এই শিক্ষার্থীও অন্য সবার মতো চাকসু মানেই বুঝতেন ক্যান্টিন। তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে অকার্যকর থাকায় আমরা চাকসুকে ক্যান্টিন হিসেবেই চিনে আসছিলাম। পরবর্তীতে এর ভূমিকা সম্পর্কে জানতে পারি। নির্বাচনের পর নিশ্চয় চাকসুর ক্যান্টিন পরিচয় অতীত হবে। নির্বাচিত হলে-শিক্ষার্থীদের পক্ষে কাজ করবো।’
চাকসু নির্বাচন ‘আমাদের কাছে জাতীয় নির্বাচনের’ মতো উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেছেন, ‘নির্বাচনের কোনো কার্যক্রমে যাতে গ্যাপ না থাকে আমরা সেভাবেই এগোচ্ছি। সকলে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে এবং নিজ দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করলে আমরা স্বচ্ছ ও সুন্দর একটি নির্বাচন শিক্ষার্থীদের উপহার দিতে পারবো।’

 

২৭ হাজার ৬৩৪ ভোটার এখন অপেক্ষায়। তাদের হাতেই যে ১২ অক্টোবর লিখিত হবে নতুন এক ইতিহাস। ওই দিন যে সাড়ে তিন দশকের নিদ্রা শেষে জেগে ওঠবে চাকসু। যে চাকসুকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চিনেছে ক্যান্টিন হিসেবে, সেই চাকসু হয়তো এবার ফিরছে তার প্রকৃত পরিচয়ে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষার, সংগ্রামের আর সোনালি স্বপ্নের আলোকবর্তিকা হয়ে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট