চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

বিশ্ব রেডিওথেরাপি সচেতনতা দিবস ও বাংলাদেশ

বিশ্ব রেডিওথেরাপি সচেতনতা দিবস ও বাংলাদেশ

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ৫:৩২ অপরাহ্ণ

৭ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো পালিত হলো বিশ্ব রেডিওথেরাপি সচেতনতা দিবস। ক্যান্সার চিকিৎসার অন্যতম স্তম্ভ হওয়া সত্ত্বেও, রেডিওথেরাপি সাধারণ আলোচনায় প্রায়ই আড়ালে থেকে যায়। অস্ত্রোপচার বা কেমোথেরাপির নাম সবাই জানে, কিন্তু রেডিওথেরাপি, যা প্রায় অর্ধেক ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় অপরিহার্য, তার যথাযথ গুরুত্ব প্রায়শই অনুল্লেখিত থাকে। এ কারণে দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হলো জনসচেতনতা তৈরি, অগ্রগতি তুলে ধরা এবং উন্নত চিকিৎসার ন্যায্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো।

 

কেন রেডিওথেরাপি অপরিহার্য : বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্যান্সার চিকিৎসার অংশ হিসেবে রেডিওথেরাপি গ্রহণ করেন। গবেষণা বলছে, প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ রোগী তাঁদের চিকিৎসার কোনো না কোনো পর্যায়ে এ সেবা থেকে উপকৃত হন। এটি কখনও মূল চিকিৎসা, কখনও অস্ত্রোপচারের আগে বা পরে সহযোগী চিকিৎসা, আবার অনেক সময় উন্নত পর্যায়ে ব্যথা ও জটিলতা উপশমের উপায়। আধুনিক প্রযুক্তি এখন রেডিওথেরাপিকে অনেক বেশি নির্ভুল করেছে। লিনিয়ার এক্সিলারেটর (খওঘঅঈ) নামের যন্ত্র টিউমারে সুনির্দিষ্টভাবে রেডিয়েশন পাঠায় এবং আশপাশের সুস্থ টিস্যু সুরক্ষিত রাখে। ফলাফল হলো, উন্নত বেঁচে থাকার হার, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হ্রাস এবং রোগীর জীবনের মানোন্নয়ন।

 

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বৈষম্য : রেডিওথেরাপির কার্যকারিতা প্রমাণিত হলেও, এর প্রাপ্যতা বিশ্বজুড়ে সমান নয়। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (ওঅঊঅ)-এর তথ্য অনুযায়ী, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে যেসব রোগীর রেডিওথেরাপি প্রয়োজন, তাঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি এ চিকিৎসা পান না।

 

প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলে : যন্ত্রপাতির উচ্চ খরচ, পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব, প্রশিক্ষিত জনবলের সংকট। বর্তমানে রেডিওথেরাপির শীর্ষ যন্ত্র উৎপাদক হলো মার্কিন কোম্পানি ঠধৎরধহ এবং ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান ঊষবশঃধ। তারা বিভিন্ন দেশে সাশ্রয়ী সমাধান, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং নতুন ব্যবসায়িক মডেলের মাধ্যমে প্রাপ্যতার ফাঁক কমাতে কাজ করছে।

 

মানুষের পেছনের গল্প : প্রতিটি মেশিনের আড়ালে কাজ করছেন এক বহুমুখী দল- রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট: রোগী নিরীক্ষণ ও চিকিৎসাপরিকল্পনা তৈরি করেন। মেডিকেল ফিজিসিস্ট: যন্ত্রপাতি ও পরিকল্পনার নির্ভুলতা নিশ্চিত করেন। রেডিয়েশন থেরাপিস্ট (জঞঞং): প্রতিদিন রোগীদের চিকিৎসা দেন, ব্যাখ্যা করেন এবং মানসিকভাবে পাশে থাকেন। নার্স ও অন্যান্য সদস্য: রোগীর সেবাযাত্রা সহজ করে তোলেন। রেডিওথেরাপি সচেতনতা দিবস এ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদেরও সম্মান জানায়, যাঁদের প্রচেষ্টায় প্রযুক্তি বাস্তবে নিরাময়ে রূপ নেয়।

 

বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র : বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, কিন্তু রেডিওথেরাপির সুযোগ এখনো অত্যন্ত সীমিত। সরকারি খাতে হাতে গোনা কয়েকটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর কার্যকর। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখনও পুরনো কোবাল্ট-৬০ মেশিনে চিকিৎসা চলছে। ঢাকার জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে মাত্র একটি কার্যকর লিনিয়ার এক্সিলারেটর আছে। বেসরকারি খাতে আধুনিক যন্ত্র থাকলেও সেগুলো মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। চট্টগ্রামে মা ও শিশু হাসপাতালে একটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর ও সিটি সিমুলেটর আছে, এভারকেয়ার হাসপাতালে আছে একটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর।

চাহিদা বনাম বাস্তবতা: ওঅঊঅ-এর হিসাবে বাংলাদেশে অন্তত ২০০টি লিনিয়ার এক্সিলারেটর দরকার, অথচ বর্তমানে এর সংখ্যা অতি নগণ্য।

 

চ্যালেঞ্জ ও সংকট : বাংলাদেশে রেডিওথেরাপির প্রসারে বেশ কিছু জটিল বাধা রয়েছে-
যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতি ও ভুল নীতি, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণের অভাব, স্বাস্থ্যসেবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি, ফলে চিকিৎসকরা অনেক ক্ষেত্রে কেমোথেরাপিকে বেশি ব্যবহার করছেন, যদিও আধুনিক চিকিৎসায় মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম ছাড়া ক্যান্সার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

 

আশার আলো ও ভবিষ্যৎ করণীয় : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই আটটি বিভাগীয় ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বহুতল ভবনের কাজ শেষপর্যায়ে রয়েছে। তবে শুধু ভবন নির্মাণ নয়, সঠিক জনবল নিয়োগ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং প্রশিক্ষণ ছাড়া এসব হাসপাতাল কার্যকর হবে না।

 

বাংলাদেশের জন্য জরুরি করণীয় হলো- দক্ষ জনবল তৈরি (জঞঞ, মেডিকেল ফিজিসিস্ট, ডোজিমেট্রিস্ট ইত্যাদি)। স্বচ্ছ নীতিতে পর্যাপ্ত লিনিয়ার এক্সিলারেটর ক্রয় ও বিভাগীয় শহরে বিতরণ। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তা কাজে লাগানো। দীর্ঘমেয়াদি ক্যান্সার কেয়ার স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন। জনসচেতনতা বাড়ানো, যাতে মানুষ ভয় না পেয়ে রেডিওথেরাপিকে গ্রহণ করেন।

 

উপসংহার : রেডিওথেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসার জীবনরক্ষাকারী একটি মাধ্যম। বিশ্ব রেডিওথেরাপি সচেতনতা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যন্ত্রপাতি, জনবল ও নীতি সমন্বয় না হলে বাংলাদেশে কার্যকর ক্যান্সার চিকিৎসা সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সঠিক বিনিয়োগ থাকলে, আগামী দিনে রেডিওথেরাপি দেশের প্রতিটি মানুষের নাগালে পৌঁছাতে পারবে।

 

লেখক : রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, সেইন্ট জন রিজওনাল হসপিটাল, নিউ ব্রুান্সউইক। এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসি ইউনিভার্সিটি, কানাডা।

 

পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট