চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

মন্তব্য প্রতিবেদন

কাতার আক্রমণের পর ন্যাটো ধাঁচের আরব জোট : সম্ভাবনা ও বাস্তবতা

ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, সম্পাদক

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ

২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় রচিত হলো। ইসরায়েল কাতারের রাজধানী দোহায় হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালাল। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল (জিসিসি) অঞ্চলের একটি রাষ্ট্রে সরাসরি আঘাত হানল ইসরায়েল। ঘটনাটি শুধু কাতারের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন নয়, পুরো উপসাগরীয় নিরাপত্তা কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
কাতার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেও বার্তাটি পরিষ্কার: অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কিংবা পশ্চিমা শক্তির ছায়াতলে থেকেও নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। আরব ও ইসলামি বিশ্ব একযোগে কাতারের পাশে দাঁড়ালেও, বাস্তবে প্রতিরক্ষা দায়িত্ব ভাগাভাগি করার মতো কোনো কাঠামো তাদের নেই। ফলে আবারও সামনে এলো ন্যাটো ধাঁচের আরব জোটের ধারণা।

 

পুরনো স্বপ্ন, নতুন প্রয়োজন:
২০১৫ সালে মিশর শারম আল-শেখ সম্মেলনে প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিল একটি যৌথ আরব সামরিক বাহিনীর। কিন্তু কে নেতৃত্ব দেবে, কোন শহরে সদর দপ্তর হবে, কে কত অর্থ দেবে-এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। প্রস্তাবটি ধুলোমাখা ফাইলেই রয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু দোহায় হামলা যেন সেই পুরনো স্বপ্নে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। উপসাগরীয় ধনী রাষ্ট্রগুলো এখন বুঝতে পারছে, একা কেউই অরক্ষিত নয়। ইরানকে ঘিরে অনিশ্চয়তা, ইসরায়েল-হামাস সংঘাত, আর পশ্চিমা শক্তির সীমিত ভূমিকা সব মিলিয়ে আরব দেশগুলো ক্রমেই নিজেদের নিরাপত্তা নিজস্ব কাঁধে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।

 

কেমন হতে পারে এ জোট:
একটি ন্যাটো-ধাঁচের জোট মানে হলো যৌথ কমান্ড কাঠামো, সেনা, অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তির ভাগাভাগি, গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান, নিয়মিত যৌথ মহড়া এবং আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা তহবিল। প্রাথমিকভাবে সৌদি আরব, কাতার, ইউএই, কুয়েত, বাহরাইন ও ওমান নেতৃত্বে থাকতে পারে। পরে যুক্ত হতে পারে মিশর, জর্ডান কিংবা মরক্কো।

 

পথের যেসব কাঁটা :
আস্থার সংকট: সৌদি আরব-কাতার টানাপোড়েন কিংবা ইউএই’র স্বতন্ত্র কৌশল অনেক প্রশ্ন তোলে।
নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা: সৌদি আরব প্রাকৃতিকভাবেই নেতৃত্ব চাইবে, কিন্তু মিশরের মতো শক্তি কি তা মানবে?
খরচের ভার: ধনী উপসাগরীয় দেশগুলো অর্থ দেবে, উত্তর আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলো সেনা দেবে-এই ভারসাম্য টিকবে তো?
বহিরাগত শক্তি: যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরে উপসাগরের নিরাপত্তার প্রধান ভরসা। ন্যাটো-ধাঁচের জোট হলে ওয়াশিংটনের ভূমিকা কোথায় দাঁড়াবে? আবার রাশিয়া-চীনও নিশ্চুপ থাকবে না।

 

জোটে কী লাভ হতে পারে:
যদি জোটটি বাস্তবায়িত হয়, তিনটি বড় সুফল আসতে পারে। প্রথমত, প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। এক দেশের উপর আক্রমণ মানে পুরো জোটের উপর আক্রমণ। দ্বিতীয়ত, উপসাগরীয় তেল-গ্যাস রপ্তানি সুরক্ষিত থাকবে, বৈশ্বিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকবে। তৃতীয়ত, যৌথ মহড়া ও প্রযুক্তি বিনিময়ে সেনাবাহিনী আধুনিকায়ন লাভ করবে।

 

বাংলাদেশের জন্য বার্তা:
বাংলাদেশের জন্য এ ঘটনাপ্রবাহে শিক্ষণীয় দিক আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সার্ক বা বিমস্টেক থাকলেও নিরাপত্তা সহযোগিতার কার্যকর কাঠামো নেই। অথচ ভারত মহাসাগর এখন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্র। কাতারের মতো সমৃদ্ধ রাষ্ট্রও যখন অরক্ষিত, তখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতা অপরিহার্য। ছোট রাষ্ট্রের জন্য বহুপাক্ষিক নিরাপত্তা ছাতা ছাড়া বিকল্প নেই।
কাতার আক্রমণ এক নতুন বাস্তবতা সামনে নিয়ে এসেছে। নিরাপত্তা আর বাইরে থেকে আমদানি করা যায় না, তা গড়ে তুলতে হয় অভ্যন্তরীণ ঐক্যের মাধ্যমে। ন্যাটো ধাঁচের আরব জোট হয়তো কালই গড়ে উঠবে না, তবে আলোচনার সূচনা হয়েছে-এটাই বড় পদক্ষেপ।
মধ্যপ্রাচ্য যদি নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজের হাতে নিতে পারে, তবে তা কেবল উপসাগরীয় অঞ্চলের নয়, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্যও মাইলফলক হবে। আর বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এটি স্পষ্ট বার্তা: একা নয়, আঞ্চলিক ঐক্যের মাধ্যমেই ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

শেয়ার করুন