চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সাবেক মন্ত্রীর ‘ইচ্ছেপূরণ’, প্রকল্পে ডুবছে পাউবো
ফাইল ছবি

সাবেক মন্ত্রীর ‘ইচ্ছেপূরণ’, প্রকল্পে ডুবছে পাউবো

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

সমীক্ষার ভুলে এক প্রকল্পে ৮ বছর ধরে হাবুডুবু খাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রায় চারশ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী ও ইছামতি নদীর ভাঙনরোধ এবং ড্রেজিং প্রকল্প পাস হয়। ২০২১ সালে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরমধ্যে বেড়েছে প্রকল্পের সময় ও ব্যয়।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা জানান, সাবেক এক মন্ত্রীর ‘ইচ্ছেপূরণে’ তড়িঘড়ি করে বড় আকারের প্রকল্প নেওয়া হয়। কাপ্তাই, রাঙ্গুনীয়া ও বোয়ালখালী অংশে মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার জন্য এ প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু চাপে পড়ে দ্রুত প্রকল্প নিতে গিয়ে ভালোভাবে সমীক্ষা করা যায়নি। ইছামতি নদীতে ড্রেজিংয়ের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকলেও প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে এখনো। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং নিয়ে শুরু থেকেই ছিল অনিয়ম-দুর্নীতি ও বালু লুটের অভিযোগ।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মন্ত্রীর চাপে পড়ে দ্রæত যেনতেনভাবে ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়েছে। পাস হওয়ার পর ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে কাজের ভাগাভাগি হয়েছে সাবেক ওই মন্ত্রীর ইচ্ছায়। তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম বদলি করে পুরো প্রকল্প নিজের আয়ত্বে নিয়ে নেন মন্ত্রী। পাউবোর কর্মকর্তারা অনেকটা নিরুপায় ছিলেন।’

 

পাউবো সূত্র জানায়, কর্ণফুলী ও ইছামতি নদী, বিভিন্ন খালের তীর সংরক্ষণ এবং নদী দু’টির ড্রেজিং করার জন্য প্রায় ৩৯৯ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়। প্রকল্পটি দু’ভাগে ভাগ করা হয়। নদী ড্রেজিংয়ে ২০০ কোটি ১০ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। আর তীর সংরক্ষণে প্রায় দুশ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন হয়।

 

প্রকল্পের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, কর্ণফুলী ও ইছামতি নদী থেকে প্রায় ৭২ লাখ ঘনমিটার বালু/মাটি উত্তোলন করা হয়। কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট থেকে নাজিরচর এলাকা পর্যন্ত ড্রেজিং করা হবে। এরমধ্যে কর্ণফুলী নদীতে ১০ কিলোমিটার ও ইছামতি নদীর ৬ কিলোমিটার ড্রেজিং করার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শুরু করতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়ে পাউবো। ইছামতির প্রবেশমুখে ড্রেজার মেশিন প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা, পাউবো’র বাঁধ ও স্লুইস গেটের ক্ষতির আশঙ্কায় ওই অংশটি বাদ দেওয়া হয়। পাউবো’র সমীক্ষার ভুলে এখন মাশুল গুনতে হচ্ছে। ওই অংশে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২৫ কোটি টাকা।

 

পাউবো ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ড্রেজিং প্রকল্প নিয়ে কর্ণফুলীর নদীর বালু হরিলুট হয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এক মন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিবার এবং আওয়ামী লীগের বালুখেকোরা ড্রেজিংয়ের নামে নদীর বালু লুটে খেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও ড্রেজিং বালুর হরিলুট হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইশারায়। এতে নদী ড্রেজিংয়ের সুফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

 

এক কর্মকর্তা বলেন, ইছামতির নদীর ড্রেজিং প্রকল্পের টাকা হরিলুটে বিকল্প প্রকল্প নেওয়া হয়। ওই টাকার সঙ্গে প্রকল্পের আকার, ব্যয় ও সময় বাড়িয়ে প্রতিরক্ষা প্রকল্প নেয়া হয়। অথচ নিয়ম মতে, সাশ্রয়ী টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা। যে প্রকল্প নিয়ে এখনো হাবুডুবু খাচ্ছে পাউবো। তিনি বলেন, ইছামতির নদী ড্রেজিংয়ের ২৫ কোটির টাকার সঙ্গে ব্যয় বাড়িয়ে প্রায় ১১০ কোটি টাকা করা হয়। সাবেক এক মন্ত্রী নিজের ইচ্ছেমতো ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে কাজ ভাগ বাটোয়ারা করেছেন। এ নিয়ে এখনো দুর্দশা ভোগ করতে হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সামশুল আরেফিন বলেন, কয়েক মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে।

 

পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে অনিয়ম : ২০২০ সালে কর্ণফুলী নদী ড্রেজিংয়ের ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রয়াত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পরিবারের সম্পৃক্ততার অভিযোগে কার্যাদেশ বাতিল করা হয়। পরে পছন্দনীয় ঠিকাদারকে কাজ পাইতে দিতে কাটছাঁট করা হয়। তিন প্যাকেজের কাজ ভেঙে ছয় প্যাকেজে করা হয়। কাজ পায় আওয়ামী লীগ ঘরানার চার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তৎকালীন সরকারদলীয় প্রভাবশালী মন্ত্রীর পরিবারের ‘কমিশন’ বাণিজ্য ও বালু লুট প্রকল্পে পরিণত হয় কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং প্রকল্প।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট