
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে একটি। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০% অবদান রাখে। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ প্রধান ক্রেতা দেশগুলি মাঝে মাঝে বিভিন্ন শুল্ক বা বাণিজ্য বিধিনিষেধ আরোপের হুমকি দেয়, যা রপ্তানির ধারাবাহিকতার জন্য একটি বড় ঝুঁকি তৈরি করে। ২০২৫ সালের পরে, যখন বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের বিভাগে চলে যাবে, তখন অনেক অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য এখনই প্রস্তুতি নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের উপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। দেশটির বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর এই শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি বিদ্যমান ১৬.৫ শতাংশ আমদানি শুল্কের সাথে যোগ করা হবে। বিজিএমইএ-এর হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা তৈরি পোশাকের উপর কার্যকর শুল্ক হার ৩৬.৫ শতাংশ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভবিষ্যতে শুল্ক হুমকি এড়াতে, বাংলাদেশকে একটি বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করতে হবে যা বাণিজ্য স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করবে, বাজারকে বৈচিত্র্যময় করবে এবং প্রায়শই এই ধরণের হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এমন অন্তর্নিহিত উদ্বেগগুলি মোকাবেলা করবে।
বাংলাদেশের বিবেচনা করা উচিত এমন মূল পদক্ষেপগুলির একটি বিশদ বিবরণ এখানে দেওয়া হল:
রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ: রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমানে আমাদের রপ্তানির একটি বড় অংশ (৮০% এরও বেশি) তৈরি পোশাক শিল্প এবং কয়েকটি সীমিত বাজারের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন) উপর নির্ভরশীল। একটি একক খাত এবং একক বাজারের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ। অতএব, বাংলাদেশের উচ্চ সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলিকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন যেমন:
*অপ্রচলিত পণ্যের উপর জোর দেওয়া
*কৃষি পণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার
*চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য
*ওষুধ
*জাহাজ নির্মাণ শিল্প
*হালকা প্রকৌশল শিল্প
*আসবাবপত্র এবং হস্তশিল্প
রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্যকরণ: একটি দেশের উচিত সীমিত সংখ্যক দেশের উপর নির্ভর না করে বিভিন্ন অঞ্চল/দেশে তার রপ্তানি পণ্য ছড়িয়ে দেওয়া। অর্থাৎ, নতুন বাজার খুঁজে বের করা, নতুন ক্রেতা তৈরি করা এবং বিভিন্ন দেশের ভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী রপ্তানি কৌশল গ্রহণ করা। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংকটে একটি নির্দিষ্ট দেশের উপর নির্ভর করলে বড় ক্ষতি হতে পারে।
বাংলাদেশে বাজার বৈচিত্র্যের বর্তমান চিত্র এখনও সীমিত; রপ্তানি মূলত তৈরি পোশাক, চামড়া এবং কৃষি পণ্যের উপর ভিত্তি করে এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট দেশের উপর নির্ভরশীল, যা বাজারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে মাত্র ১০টি দেশ থেকে, যা একটি বড় ঝুঁকির কারণ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে, বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে এটি ৮.৬৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছিল – যা মোট রপ্তানির প্রায় ১৮%। এর মধ্যে, বৃহত্তম রপ্তানি ছিল বোনা পোশাক (শার্ট, প্যান্ট) এবং নিটওয়্যার (টি-শার্ট, সোয়েটার)।
জার্মানিতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫.২৯ বিলিয়ন ডলার, যেখানে নিটওয়্যার সবচেয়ে জনপ্রিয়। এবং যুক্তরাজ্যে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪.৬২ বিলিয়ন ডলার – ব্রেক্সিটের পরেও এটি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলির মধ্যে একটি।
পণ্য বৈচিত্র্যের পাশাপাশি, বাজার বৈচিত্র্য ও প্রয়োজন। এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য – হল নতুন উদীয়মান বাজার যেখানে বাংলাদেশের জন্য দুর্দান্ত সুযোগ রয়েছে।
কূটনৈতিক ও বাণিজ্য আলোচনার সক্ষমতা জোরদার করন: বিশ্বায়নের যুগে, বাণিজ্য কেবল একটি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নয়, বরং কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য, নতুন বাজার তৈরি করতে, শুল্ক হুমকি মোকাবেলা করতে এবং বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য একটি দেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি এবং আলোচনার ক্ষমতা অপরিহার্য। যেহেতু বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ করছে, তাই এটি অনিবার্য যে এটি শুল্ক সুবিধা হারাবে এবং নতুন বাণিজ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি বিশেষায়িত বাণিজ্য আলোচনা সেল গঠন করতে হবে, WTO, FTA, RTA সম্পর্কিত বিষয়গুলিতে একটি বিশেষজ্ঞ পুল তৈরি করতে হবে। একটি জাতীয় বাণিজ্য কাউন্সিল গঠন করা এবং সমস্ত অংশীদারদের এক প্ল্যাটফর্মে আনা অপরিহার্য।
আমাদের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলিতে বাণিজ্যিক অ্যাটাশে/বাণিজ্য পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হবে এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে এবং FTA এবং PTA চুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে হবে। আমাদের BIMSTEC, ASEAN, RCEP-তে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
বৈশ্বিক মান মেনে চলা: বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য, কেবল উৎপাদন নয়, বরং বিশ্বব্যাপী মান কঠোরভাবে মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক ক্রেতা, আমদানিকারক দেশ এবং বহুজাতিক ব্র্যান্ডগুলি এখন কেবল মূল্য নয়, মান, সুরক্ষা, নীতিশাস্ত্র এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদনকে আরও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের পণ্যের মান নিশ্চিত করার জন্য, আমাদের পণ্য উৎপাদনে আন্তর্জাতিক মান সংস্থা (ISO), ইউরোপীয় সিই মার্ক, মার্কিন FDA, GMP ইত্যাদির মান মেনে চলতে হবে। প্রতিটি শিল্পে মানসম্মত পরীক্ষাগার পরীক্ষা চালু করতে হবে। তাছাড়া, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (BSTI) কে আন্তর্জাতিক মান উন্নত করতে হবে। টেকসই উৎপাদন এবং আমাদের কার্বন পদচিহ্ন হ্রাসের জন্য আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের LEED সার্টিফাইড (গ্রিন ফ্যাক্টরি) কারখানার সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং সরকারকে এই ক্ষেত্রে আমাদের সহায়তা করতে হবে।
রপ্তানি বৃদ্ধি কেবল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমেই সম্ভব নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই বাজার অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক মান, নিরাপত্তা, নীতিশাস্ত্র এবং পরিবেশগত পরিস্থিতি মেনে চলার মাধ্যমেও সম্ভব।
বাংলাদেশ যদি শ্রম অধিকার, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে “মেড ইন বাংলাদেশ” বিশ্বব্যাপী আস্থার প্রতীক হবে।
বাণিজ্য সরবরাহ ও অবকাঠামো উন্নতকরণ : রপ্তানি বৃদ্ধিতে বাণিজ্য সরবরাহ/সরবরাহ শৃঙ্খল এবং অবকাঠামো উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি দেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতা মূলত তার পণ্যের মান + খরচ + সময়মত সরবরাহের উপর নির্ভর করে। এবং এখানেই অবকাঠামো এবং সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থার একটি বড় প্রভাব রয়েছে। অতএব, ট্রেড লজিস্টিক এবং অবকাঠামো উন্নত করার জন্য
বাংলাদেশের নিম্নলিখিত পদক্ষেপের প্রয়োজন-
*সড়ক, রেল এবং বিমান যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নত করা
*দ্রুত শুল্ক ছাড়পত্র, ডিজিটাল একক উইন্ডো সিস্টেম প্রবর্তন
*আঞ্চলিক সড়ক ও রেল সংযোগ বৃদ্ধি করে বাংলাদেশকে ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন এবং আসিয়ান দেশগুলিতে সহজেই রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে।
*চট্টগ্রাম, মংলা এবং পায়রা বন্দরের আধুনিকীকরণ এবং গভীর সমুদ্র বন্দরগুলির দ্রুত কমিশনিং।
ই-কমার্স, আইটি পরিষেবা এবং ডিজিটাল বাণিজ্যের জন্য একটি শক্তিশালী ইন্টারনেট এবং আইসিটি অবকাঠামো তৈরি করা।
*সকল বিমানবন্দরে কার্গো সুবিধা উন্নত করা, যার মধ্যে পচনশীল পণ্য (তাজা খাবার, ফুল, ওষুধ) রপ্তানির জন্য বিমানবন্দর কোল্ড-চেইন লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করা অন্তর্ভুক্ত।
তাই বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য শুল্ক হুমকি মোকাবেলায় একটি বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে রপ্তানি বাজার এবং পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, আন্তর্জাতিক মান এবং নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণকরণ, কূটনৈতিক বাণিজ্য জোরদার করা এবং প্রযুক্তি ও শিল্প উন্নয়নে বিনিয়োগ করা। এইভাবে, বাংলাদেশ রপ্তানিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে, তার প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বজায় রাখতে এবং অপ্রত্যাশিত বাণিজ্য বাধার প্রভাব কমাতে সক্ষম হবে।
লেখক : মার্কেটিং ম্যানেজার, এইচকেডি ইন্টারন্যাশনাল
পূর্বকোণ/আরআর