চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

দারিদ্র্যের ঊর্ধ্বমুখী ঢেউ ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সংকট

দারিদ্র্যের ঊর্ধ্বমুখী ঢেউ ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সংকট

আবসার মাহফুজ

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ৪:২০ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার তিন বছরে প্রায় দ্বিগুণ হারে বেড়ে যাওয়া নিছক একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি জাতির অস্তিত্বসংকটের এক নির্মম দলিল। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা বলছে, তিন বছর আগে ২০২২ খ্রিস্টাব্দে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ, সেখানে চলতি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে এসে তা ২৭.৯৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ এখন দেশে প্রতি চারজনে একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আরও ভীতিকর হলো, প্রতি দশজনের একজন এখন চরম দারিদ্র্যের শিকার, যারা ন্যূনতম মৌলিক চাহিদাও পূরণ করতে পারে না। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এলজিইডি মিলনায়তনে গত ২৫ আগস্ট এ গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেভেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান।

পিপিআরসি’র এই পরিসংখ্যান শুধু বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতাই নয়, বরং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সংহতি ও মানবিক মর্যাদার ভবিষ্যৎ চিত্রকেও নির্দেশ করছে। পিপিআরসি’র গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু দারিদ্র্য নয়, অতি দারিদ্র্যও বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৫.৬ শতাংশ। তিন বছরের ব্যবধানে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৩৫ শতাংশে। অর্থাৎ এখন প্রতি ১০ জনের একজন চরম দারিদ্র্যে ভুগছে। এ ছাড়া প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ এমন অবস্থায় আছে, যেকোনো সময় তারা দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে শহরের পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা। বর্তমানে আয় কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকায়। অথচ খরচ বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকায়। অর্থাৎ শহরে আয় কমলেও খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে গ্রামের পরিবারে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে যেখানে মাসিক গড় আয় ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে ২৯ হাজার ২০৫ টাকা হয়েছে। তবে আয় সামান্য বাড়লেও জাতীয়ভাবে সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। পিপিআরসি’র গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, পরিবারের খরচের বড় অংশই চলে যাচ্ছে খাবারের পেছনে। গবেষণা বলছে, একটি পরিবারের মাসিক খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ ব্যয় হয় শুধু খাদ্যে। গড়ে একটি পরিবার খাবার কেনায় খরচ করছে ১০ হাজার ৬১৪ টাকা। এর বাইরে শিক্ষায় এক হাজার ৮২২ টাকা, চিকিৎসায় এক হাজার ৫৫৬ টাকা, যাতায়াতে এক হাজার ৪৭৮ টাকা এবং আবাসনে প্রায় এক হাজার ৯০ টাকা ব্যয় হয়। ফলে অন্যান্য খাতে খরচ করার বা সঞ্চয় রাখার সামর্থ্য পরিবারের হাতে থাকে না।

 

বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় গত দুই দশক ধরে আমরা একধরনের আত্মতুষ্টিতে ভুগে আসছিলাম। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল উচ্চমাত্রায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছিল, পোশাকশিল্প ও প্রবাসী আয়ের স্রোত তৈরি করেছিল একধরনের প্রবৃদ্ধির মায়া। কিন্তু সেই মায়ার আড়ালে বৈষম্য ও দারিদ্র্য সংকট লুকিয়ে ছিল। কোভিড-১৯ মহামারি সেই দুর্বলতাকে উন্মোচন করে দিয়েছে, আর লাগাতার মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সেই সংকটকে গভীর করেছে। এর ফল আজ আমাদের চোখের সামনেই লক্ষ লক্ষ পরিবার আবার দারিদ্র্যের ফাঁদে। পিপিআরসি’র গবেষণা অনুযায়ী, শহরের পরিবারগুলো আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করছে, ফলে তারা সঞ্চয় তো দূরের কথা, মাসিক খরচই মেটাতে পারছে না। গ্রামে সামান্য আয় বৃদ্ধি হলেও তা মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলাতে পারেনি। এর ফলে জাতীয়ভাবে সঞ্চয়ের সুযোগ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত, সবচেয়ে বড় ব্যয়ের খাত খাদ্য। একটি পরিবারের মাসিক ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি, প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যাচ্ছে খাবার কিনতে। গড়ে একটি পরিবার শুধু খাবারের জন্য খরচ করছে ১০ হাজার ৬০০ টাকারও বেশি। এর বাইরে শিক্ষা, চিকিৎসা, যাতায়াত ও আবাসনে ন্যূনতম ব্যয় করার পর হাতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এর ফলে একদিকে যেমন জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন আটকে যাচ্ছে, অন্যদিকে সঞ্চয় বা বিনিয়োগের সুযোগও হারিয়ে যাচ্ছে। অতি দারিদ্র্য বৃদ্ধির বিষয়টি আরও ভীতিকর। সরকারি হিসেবে ২০২২ খ্রিস্টাব্দে যেখানে অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৫.৬ শতাংশ, এখন তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৩৫ শতাংশে। এর মানে হচ্ছে, কোটি কোটি মানুষ একবেলা খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ রয়েছে এক অনিশ্চিত অবস্থায়- সামান্য আঘাতেই তারা দরিদ্র্যের কাতারে নেমে যাবে। এ এক ধরনের ‘অদৃশ্য দারিদ্র্য’, যা পরিসংখ্যানের বাইরে থেকেও জাতির জন্য ভয়ঙ্কর সংকেত বয়ে আনে।

 

পিপিআরসি’র গবেষণায় দুর্নীতি ও ঘুষের চিত্রও উঠে এসেছে। বলা হয়, গত বছরের আগস্টের পর ঘুষ দেওয়ার প্রবণতা কিছুটা কমলেও তা বন্ধ হয়নি। আগস্টের আগে যেখানে ৮.৫৪ শতাংশ মানুষ সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দিয়েছেন। আগস্টের পর তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৩.৬৯ শতাংশে। সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে সরকারি অফিসে, এরপর পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের দিতে হয়। পিপিআরসির গবেষণা বলছে, দারিদ্র্য বৃদ্ধির পেছনে তিনটি মূল কারণ কাজ করছে। প্রথমত, কোভিড-১৯ মহামারি অর্থনীতির ভেতরে এক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করেছে। লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ধসে পড়েছে, স্কুলছুট বেড়েছে, ঋণের বোঝা বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, লাগাতার মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না, ফলে এক ধরনের ‘বেকারত্বের দুর্যোগ’ দেখা দিয়েছে। কর্মসংস্থানের এই সংকট দারিদ্র্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় চালক। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী বের হচ্ছে, কিন্তু তারা শ্রমবাজারে জায়গা পাচ্ছে না। শিল্পায়নের গতি থমকে গেছে, কৃষিখাতেও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। অথচ জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ, যাদের হাতে কাজ না থাকলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে, অপরাধ বাড়বে, রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যাবে। দারিদ্র্য শুধু পেটের ক্ষুধা নয়, এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও এক বড় হুমকি।

 

উল্লেখ্য, সংকটকে আরও জটিল করছে দুর্নীতি ও ঘুষ। যদিও গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুষ দেওয়ার হার কিছুটা কমেছে, তবুও সরকারি অফিস, পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ঘুষ দিতে হচ্ছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষদের জন্য এ এক দ্বিগুণ বোঝা। একদিকে তারা ন্যূনতম চাহিদা পূরণে ব্যর্থ, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে ঘুষ দিতে হচ্ছে। ফলে দারিদ্র্য থেকে বের হওয়ার পথ আরও সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। আবার দারিদ্র্যের এই উত্থান সামাজিক বৈষম্যকেও বাড়িয়ে তুলছে। যারা ধনী, তারা আরও ধনী হচ্ছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত ক্রমেই নিম্নবিত্তে নামছে। নারীপ্রধান পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ছে, কারণ তাদের হাতে আয় সীমিত, আবার স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার খরচ, গৃহস্থালির দায়- সব একসঙ্গে চাপ ফেলছে। দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস, ক্যানসার বা কিডনি রোগ এখন গরিব পরিবারের জন্য চরম দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে তারা ঋণগ্রস্ত হচ্ছে, জমিজমা বিক্রি করছে, আর্থিক নিরাপত্তা একেবারে ভেঙে পড়ছে।

 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দারিদ্র্যসংকট থেকে উত্তরণের পথ কী? প্রথমত, নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। মানুষের কল্যাণ, সামাজিক সুরক্ষা ও বৈষম্য হ্রাসকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) জন্য সহজ ঋণপ্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি। কৃষিখাতে মূল্যসংযোজনমূলক শিল্প গড়ে তুলতে হবে, যাতে গ্রামে নতুন কর্মসংস্থান হয়। তৃতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে আরও কার্যকর ও লক্ষ্যভিত্তিক করতে হবে। ভাতাভোগীদের তালিকায় দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, কারণ মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া দারিদ্র্য হ্রাস সম্ভব নয়। চতুর্থত, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা জরুরি। নিত্যপণ্যের দামে সিন্ডিকেটের প্রভাব ভাঙতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিনিয়োগ তখনই বাড়বে, যখন উদ্যোক্তারা বিশ্বাস করবে যে, দেশে আইনের শাসন আছে, নীতিমালা স্থিতিশীল আছে, রাজনৈতিক সহিংসতার ঝুঁকি কম। কিন্তু যদি অর্থনীতি অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে, তাহলে দারিদ্র্য হ্রাসের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে।

 

বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে, আমরা বারবার সংকট কাটিয়ে উঠেছি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈদেশিক চাপ, রাজনৈতিক অস্থিরতা- সবই মোকাবিলা করেছি। কিন্তু এবার সংকটটি বহুমাত্রিক। এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিকও বটে। তাই এর সমাধানও বহুমুখী হতে হবে। বিশেষজ্ঞা বলছেন, দারিদ্র্য হ্রাসকে কেবল একটি উন্নয়ন সূচক নয়, বরং একটি নৈতিক দায় হিসেবে দেখতে হবে। কারণ, রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হলো নাগরিকদের ন্যূনতম জীবিকা নিশ্চিত করা। যদি লাখ লাখ মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে, ঋণগ্রস্ততায় দিন কাটায়, তাহলে রাষ্ট্রের অর্জন কোনোভাবেই টেকসই হবে না। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ আজ যে দারিদ্র্যের ঢেউয়ের মুখোমুখি, তা আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। এই সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করলে আমরা এমন এক সংকটে পড়ব, যেখান থেকে উত্তরণ কঠিন হবে। তাই এখনই দরকার দূরদর্শী নেতৃত্ব, বাস্তবমুখী নীতি এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দারিদ্র্য কেবল সংখ্যার খেলা নয়, এটি মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। আর সেই সংগ্রামে রাষ্ট্র যদি পাশে না দাঁড়ায়, তবে উন্নয়ন হবে নিছক এক মরীচিকা। রাষ্ট্রকে তা অনুধাবন করতে হবে। আর সবকিছুই বিবেচনায় নিয়ে সংকট উত্তরণে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট