
বয়স আর কত? মাত্র ১১। কৈশোরের গণ্ডি পার না হওয়া ছেলেটার নাম ছিল মোহাম্মদ রাসেল। শখ করে লম্বা চুল রেখেছিল সে। ঘুমের মধ্যে দুষ্টুমির ছলে তার সেই শখের চুলে কাঁচি বসিয়ে এলোমেলো করে দেয় বন্ধুরা। ঘুম ভেঙে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের এই হাল দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি সে। বিষয়টি নিয়ে মায়ের সঙ্গেও হলো একপ্রস্ত অভিমান। ছোট্ট মন এতটাই বাষ্পরুদ্ধ হয়ে ওঠে, সিদ্ধান্ত নেয় আর থাকবে না এই পৃথিবীতে। নিজের কথা রেখে-সবার অগোচরে ঘরের বিমের সঙ্গে রশি টাঙিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে। ঘটনাটি ঘটে ১০ জুলাই, চট্টগ্রামের পটিয়ার কেলিশহর এলাকার গুচ্ছগ্রামে।
এমন ঠুনকো অভিমানেই ঝরে যাচ্ছে কত ‘মহার্ঘ জীবন’। পটিয়ার রাসেলের মতোই আত্মহত্যার মিছিল লম্বা হচ্ছে চট্টগ্রামে। গত ১০০ দিনে এখানে অন্তত ২৩ জন আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ প্রতি পাঁচদিনে একজন মানুষ নিজের জীবন নিজেই বিসর্জন দিচ্ছেন। মারা যাওয়াদের ২২ জনের বয়সই আবার ১১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
প্রতি পাঁচদিনে একজনের আত্মহত্যা:
চলতি বছরের জুনে চট্টগ্রামে ছয়জন আত্মহত্যা করেন। তাদের মধ্যে চারজন তরুণী। ৫ জুন প্রেমিকের সঙ্গে অভিমান করে গলায় ফাঁস দেন রাউজানের ছিটিয়াপাড়া এলাকার লিজা আক্তার। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও গড়িমসি করায় ১৮ বছরের এ তরুণী আত্মহত্যা করেন। ৭ জুন বাবার সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করেন চকরিয়ার শফিকুল ইসলাম। বাবা দোকানের জন্য টাকা না দেওয়ায় এ কাণ্ড ঘটান ২৩ বছরের তরুণ। বারবার বাড়িতে গিয়েও মাকে না পেয়ে অভিমান করে গলায় গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন মো. মামুন। ২৪ বছরের মামুনের বাড়ি সাতকানিয়ায়। কোরবানের ঈদে বাবার বাড়ি থেকে ছাগল না পাঠানোয় বিলকিস আক্তারকে কথা শুনিয়েছিলেন স্বামী মোহাম্মদ জাহেদ। এ অপমান সইতে না পেরে বোয়ালখালীর পূর্ব গোমদণ্ডর বিলকিস গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঈদের পরদিন গত ৮ জুন নিজের জীবন সপে দেন ‘মৃত্যুর হাতে’। হাটহাজারীর মনিষা বড়ুয়া, ছিল মাত্রই ১৪ বছরের কিশোরী। ১২ জুন বসতঘর থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এত অল্প বয়সে কী কারণে এই কিশোরী ‘আত্মহত্যার পথ’ বেছে নিলো তা অবশ্য জানা যায়নি আজও। একই মাসের ২১ জুন সকালে ফটিকছড়ির কাঞ্চননগরের নিজ ঘর থেকে সাজু বেগম নামে এক গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পারিবারিক কলহেই নিজেকে শেষ করে দেন তিনি। যদিওবা তার পরিবার দাবি করেছে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জুলাই মাসেও চট্টগ্রামে ছয়জন আত্মহত্যা করেছেন। মাসের দ্বিতীয় দিনে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন রাউজানের মো. মুন্না। শ্বশুরবাড়িতে যৌতুক চাওয়ায় অপমানে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে ‘আত্মহত্যা’ করেন পটিয়ার কুসুমপুরা ইউনিয়নের গৃহবধূ ঊর্মি আক্তার। ২৮ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একটি ভাড়া বাসা থেকে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় লামিয়া তানহা নামে এক ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একইদিন বাঁশখালীর চাম্বলে স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করেন মফিজ উদ্দিন। পটিয়ার কিশোর রাসেলের কথা তো শুরুতেই বলা হলো। এর মধ্যে ১১ জুলাই এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় রশিতে ঝুলে নিজেকে শেষ করে দেয় প্রিয়তম রুদ্ধ।
আগস্ট মাসেও ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়, যারা সবাই ‘আত্মহত্যা’ করেন। তাদের মধ্যে ৪ আগস্ট স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে রাউজানের মিন্টু মিয়া, প্রেমিকার সঙ্গে অভিমান করে বন্দর এলাকার সজিব নামের এক তরুণ আত্মহত্যা করেন। ১০ আগস্ট লোহাগাড়ার চুনতিতে ট্যাক্সি কিনে না দেওয়ায় বাবার সঙ্গে অভিমান করে ‘আত্মহত্যা’ করেন রিয়াজউদ্দিন। একইদিনে বন্দর এলাকার তরিকুল ইসলাম ‘আত্মহত্যা’ করেন, ক্যাসিনোতে টাকা হারিয়ে। ২২ আগস্ট চকরিয়া থানা হাজত থেকে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয় দুর্জয় চৌধুরী নামে এক তরুণের। ৩১ আগস্ট পটিয়ায় দুটি আত্মহত্যার ঘটে। দুটি মৃত্যুই অপমানে-অভিমানে। প্রবাসী স্বামীকে ভিডিও কলে রেখে আত্মহত্যা করেন সামিয়া আক্তার নামে এক গৃহবধূ। স্ত্রী ও বাচ্চা কারাগারে যাওয়ায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি নেজাম উদ্দিন।
চলতি সেপ্টেম্বর মাসের মাত্রই ৯ দিন গড়ালো, এর মধ্যেই ৫ জনের আত্মহত্যার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। মাসের এখনো দুই তৃতীয়াংশ বাকি, এ সময়ে সংখ্যাটি আরও বাড়ার শঙ্কা থেকেই যায়।
অভিমানেই ঝরছে বেশি প্রাণ:
বেশ কয়েকবছর ধরে সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন সারাদেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার চিত্র, কারণ ও সমাধানের পথ বাতলে দেওয়ার কাজ করে আসছে। এই ফাউন্ডেশনের গবেষণায় উঠে এসেছে আত্মহত্যার শীর্ষ কারণ হলো অভিমান। ২০২৪ সালে আত্মহত্যার ২৮ দশমিক ৪ শতাংশই ঘটেছে অভিমানে। ২০২৩ সালে এই হার ছিল আরও বেশি-৩২ দশমিক ২ শতাংশ।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা:
আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, আমাদের তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট নিয়ে পরিবার, সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সচেতন নয়। প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলেও আমরা তা গুরুত্বের সঙ্গে নিই না। যার কারণে আত্মহত্যার হার লক্ষণীয় নয়।
আত্মহত্যার চেষ্টাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার আইনের যৌক্তিকতা অত্যন্ত দুর্বল বলে মন্তব্য করেন লেখক ও আইনবিদ নওফল জমির। তিনি বলেন, ‘মানসিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিশোর-কিশোরীদের আরও সহনশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’
পূর্বকোণ/ইবনুর