
নগরের ঐতিহ্যবাহী ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের মালিকানা দাবি করেছে ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা সম্পাদক প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সারের ছোট ভাই। খাস্তগীর স্কুল ভবনের (পেছনে) সঙ্গে লাগানো ছাত্রীদের খেলার মাঠের প্রায় ১৯ কাঠা নিজের নামে নামজারি করতে আরিফুল ইতিমধ্যে একাধিকবার ভূমি অফিসে আবেদন করেছেন। সর্বশেষ গত ১৬ জুলাই আবেদন করলে বাকলিয়া সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাছুমা আক্তার কণা তা খারিজ করে দেন। এরপরই বিষয়টি জানাজানি হয়।
জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলাম জানান, সমীর সেন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে আমমোক্তার (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) নামামূলে তিনি জমিটি রেজিস্ট্রি নিয়েছেন। তাই আইন অনুযায়ী নিজের নামে নামজারির আবেদন করেছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, ভুয়া আমমোক্তার নামা সৃষ্টি করে ছাত্রীদের খেলার মাঠ দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাস্তগীর স্কুলের প্রায় ১৯ কাঠা খেলার মাঠের মূল মালিক হেনরী পার্সিভ্যাল (আরএস খতিয়ান)। যার নামে নগরের দেবপাহাড় এলাকায় পার্সিভ্যাল হিল পরিচিত। তিনি মারা যাবার পর ছেলে জেমস রোনাল্ড পার্সিভ্যাল জমির মালিক হন (আর এস খতিয়ান)। রোনাল্ড মারা গেলে তার একমাত্র মেয়ে স্কলাসটিয়ানের নামে জমির পিএস খতিয়ান হয়।
স্কলাসটিয়ান মারা গেলে ছেলে জবু পল ও তার স্ত্রী সুধীয় পল জমির মালিক হন। দুজনেই মারা গেলে তাদের ছেলে জর্জ পলের নামে জমিটির বিএস খতিয়ান হয়। ২০০৬ সালে সমীর সেন নামে এক ব্যক্তি জর্জ পলের কাছ থেকে জমিটি আমমোক্তারনামা নেয় বলে দাবি করা হচ্ছে। ইংরেজিতে হাতে লেখা আমমোক্তার নামায় জর্জ পলের ঠিকানা দেখানো হয়েছে ৪২৮ নম্বর কলেজ রোড, দেব পাহাড়, চট্টগ্রাম। তবে দেব পাহাড় এলাকায় গত এক সপ্তাহ ধরে খুঁজেও জর্জ পলের ঠিকানা পাওয়া যায়নি। সমীর সেনের দাবি, তাকে আমমোক্তার নামা দেওয়ার পর জর্জ পল কানাডা চলে গেছেন।
ভূমি অফিসের প্রতিবেদন: স্কুল মাঠের বিষয়ে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি সহকারী কমিশনার (ভূমি) বাকলিয়া সার্কেলের কানুনগো মুহাম্মদ মাহিবুবুল আলম, সার্ভেয়ার ছায়েদুল আলম মজুমদার ও ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইখতেখার উদ্দিন বাকলিয়া সার্কেলের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএস রেকর্ডমূলে জমিটির মূল মালিক সুধীয় পল ও জবু পলের ওয়ারিশ জর্জ পলের কাছ থেকে ২০০৬ সালের ২৪ জুলাই ৭৮৩৬ নম্বর রেজিস্ট্রি আমমোক্তার নামা নেয় চন্দনাইশের জোয়ারা গ্রামের মৃত ননী গোপাল সেনের ছেলে সমীর সেন। সমীর সেন জমিটি ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলামের কাছে বিক্রি করে। জমিটি নিজের নামে নামজারি খতিয়ানের জন্য (ই-নামজারি মামলা) আবেদন করেন ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরোধীয় বিএস ৪০২ খতিয়ানভুক্ত বিএস ১৪৩ নম্বর দাগের ১৮ দশমিক ৪৯ কাঠা জমি ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের নামে রেকর্ড না হওয়ায় অর্থাৎ সুধীয় পল ও জবু পলের নামে রেকর্ড হওয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে স্বত্বঘোষণার জন্য সিনিয়র সহকারী জজ প্রথম আদালতে অপর মামলা (নম্বর-১৯৪/০৬) দায়ের করেন। এ মামলা দোতরফা সূত্রে খারিজ হয়। পরবর্তীতে স্কুল কর্তৃপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের ষষ্ঠ অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে অপর মামলা (৩৯৬/১১) দায়ের করেন।
বিভাগীয় কমিশনার আদালতে নামজারি মামলা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জমিটি নিয়ে ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি আদালতের দেয়া রায়ে বলা হয়েছে, নামজারি মামলার চূড়ান্ত আদেশ দেয়া আইনগতভাবে সঠিক হবে না। যেহেতু জমিটি নিয়ে রেকর্ড সংশোধনী ও স্বত্ব ঘোষণার মামলা বিচারাধীন সেহেতু উক্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নামজারি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখাই আইনসম্মতভাবে প্রতীয়মান বিধায় স্বত্ব ঘোষণার মামলা নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নামজারি মামলা কার্যক্রম স্থগিত রাখার আদেশ দেয়া হলো।
স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: খাস্তগীর স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শাহেদা আক্তার জানান, ১৯২৭ সালে কলকাতা গেজেট মূলে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখা প্রায় ৩৯ গণ্ডা জমি অধিগ্রহণ করে। ১৯৩৪ সালে সিএন্ডবি জমিগুলো পরিমাপ করে সীমানা দেয়াল নির্মাণ করে দেয়। ১৯২৭ সাল থেকে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় জমির কিছু অংশে একাডেমিক ভবন নির্মাণ করে। বাকী অংশ খেলার মাঠ হিসাবে ব্যবহার করে আসছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হবার পর তৎকালীন দায়িত্বশীলদের অনভিজ্ঞতার কারণে অধিকৃত জমি স্কুলের নামে রেকর্ড হয়নি। এতে অধিগ্রহণের পূর্ববর্তী মালিকের নামে খতিয়ানে নাম বহাল থাকে। এ অবস্থায় বিষয়টি ‘ভূমিদুস্য’ সমীর সেনের নজরে আসে। পরে সমীর ও তার কিছু সহযোগী মিলে জমিটি আত্মসাতের পরিকল্পনা হাতে নেয়। সদর ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে সাবরেজিস্ট্রারকে ম্যানেজ করে সমীর নিজের নামে একটি ভুয়া পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিল সৃষ্টি করে। এ দলিলে দাতা হিসাবে জর্জপল, ২৪৮ দেব পাহাড়, কলেজ রোড, চট্টগাম দেখানো হয়েছে। অথচ এ ঠিকানায় জর্জপল নামে কোন ব্যক্তি কখনও বসবাস করেনি।
২০০৬ সালে রাজনৈতিক কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সহায়তায় এবং থানা পুলিশ ম্যানেজ করে দেয়াল ভেঙে মাঠের জমি দখলে নিতে আসে। আদালতে মামলা করে স্কুল কর্তৃপক্ষ তা প্রতিহত করে। ১৯২৭ সালের গেজেটসহ অন্যান্য কাগজপত্র স্কুলের কাছে সংরক্ষিত না থাকায় নিম্ন আদালতের দেওয়া রায় স্কুলের বিপক্ষে যায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে মামলা বর্তমানে চলমান রয়েছে। স্কুলের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ জমিতে (১৮ দশমিক ৪৯ গণ্ডা) চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আদালতের চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং জমিটি স্কুলের দখলে থাকার নির্দেশনা দেন। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মামলা চলাকালীন সময়ে সমীর সেন ২০১৩ সালে ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলামের কাছে প্রায় ১৯ কাঠা জমি (যা ছাত্রীদের খেলার মাঠ হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে) তিন কোটি ৯৬ লাখ টাকায় কবলা দলিলমূলে বিক্রি করে দেয়। পরে আরিফুল ইসলাম মাঠটি নিজ নামে নামজারি করতে নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ