
তৃতীয় পর্ব। জাতিসংঘ প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বহুজাতিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকরক ও ভ্যানগার্ড সামনে থেকে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের অর্থ বিনিয়োগ করে। সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকরকের যেসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ রয়েছে, তার মধ্যে আছে- পালানটিয়ার (৮.৬%), মাইক্রোসফট (৭.৮%), অ্যামাজন (৬.৬%), অ্যালফাবেট (৬.৬%), আইবিএম (৮.৬%), লকহিড মার্টিনে (৭.২%) ও ক্যাটারপিলার (৭.৫%)। ভ্যানগার্ডের সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- ক্যাটারপিলার (৯.৮%), শেভরন (৮.৯%), পালানটিয়ার (৯.১%), লকহিড মার্টিন (৯.২%), ইসরায়েলি অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেমস (২%)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ঔপনিবেশিক কর্মকাণ্ড এবং সংশ্লিষ্ট গণহত্যা ঐতিহাসিকভাবে করপোরেট খাতের মাধ্যমে পরিচালিত ও সহায়তাপুষ্ট হয়ে আসছে।’ প্রতিবেদনে ইসরায়েলের দখলদারত্বকে ‘ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী পুঁজিবাদ’-এর একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সেখানে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ দখল থেকে মুনাফা অর্জন করছে। ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা শুরুর পর থেকে এই অর্থনীতির অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলো আরও গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
উল্লেখ্য, ইসরায়েলের সামরিক ব্যয় ২০২৩-২৪ খ্রিস্টাব্দে ৬৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৫০ কোটি মার্কিন ডলারে, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ মাথাপিছু সামরিক ব্যয়ের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন অস্ত্র, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারমূল্য বেড়েছে। তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জ ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে এবং এই স্টটএক্সচেঞ্জের বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৭৯০ কোটি মার্কিন ডলারে। বিমাপ্রতিষ্ঠান, যেমন অ্যালিয়্যাঞ্জ এবং অ্যাক্সা ইসরায়েলি শেয়ার ও বন্ডে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। আংশিকভাবে মূলধন রিজার্ভের জন্য হলেও প্রধানত তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফা অর্জন। এয়ারবিএনবি ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে কিছু সময়ের জন্য অবৈধ বসতির তালিকা সরিয়ে নিলেও পরে আবার যুক্ত করে এবং সেই মুনাফা ‘মানবিক’ খাতে দান করার কৌশল নেয়। প্রতিবেদনে তাদের এই কৌশলকে ‘হিউম্যানিটারিয়ান-ওয়াশিং’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। জাতিসংঘ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, এসব বড় প্রতিষ্ঠান এখন আর শুধু ইসরায়েলের দখলদারত্বে যুক্ত নয়, বরং গণহত্যার অর্থনৈতিক কাঠামোর অংশ হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের নতুন প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর সারাবিশে^র মানবিক চেতনার মানুষজন সোচ্চার হয়ে উঠেছে ইসরায়েল এবং তার ‘গণহত্যার অর্থনীতি’র সাথে যুক্ত দেশ ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। তারা এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘের প্রতি আহবান জানাচ্ছে। তবে আলবানিজের প্রতিবেদন ও বিশে^র মানবতাবাদীদের আহবান অনুযায়ী জাতিসংঘ কি ইসরায়েল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ নিতে পারবে? পারবে না, কারণ যাদের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যা পরিচালনা ও ইসরায়েলের ‘গণহত্যার অর্থনীতি’র সাথে যুক্ত থাকার সপ্রমাণ প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়েছে, তারাই জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রক। প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি তাই হয়, তাহলে আলবানিজ এমন রিপোর্ট তৈরি করলেন কীভাবে? হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে কিছু স্বাধীনচেতা ও মানবাধিকারের প্রতি দায়বদ্ধ ব্যক্তি, বা কমিশন এমন সত্য উন্মোচন করে সাহস নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সে সব রিপোর্টের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। শুধু তাই নয়, সেসব ব্যক্তি বা কমিশনপ্রধানকে সত্য উন্মোচন ও প্রকাশের জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। এখন ‘দ্য অ্যানাটমি অব আ জেনোসাইড’ শিরোনামের প্রতিবেদনে ইসরায়েলের ‘গণহত্যার অর্থনীতি’র চিত্র তুলে ধরার মাসুল দিতে হচ্ছে আলবানিজকে। সত্য উন্মোচন ও প্রকাশের দায়ে তাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে। হয়তো দ্রুত তা কার্যকর হবে। কিন্তু তার প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ দেখা যাবে না।
এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, ইসরায়েলি রাষ্ট্রযন্ত্র যে সহিংসতা ও দমননীতির মাধ্যমে ফিলিস্তিনে আধিপত্য বজায় রাখছে, তা নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়- এর পেছনে রয়েছে একটি সুসংগঠিত, পরিকল্পিত এবং লাভজনক অর্থনীতি। সামরিক প্রযুক্তি, বসতি নির্মাণ, নজরদারি শিল্প, অবরোধ এবং পণ্যের বাজার- সব ক্ষেত্রেই সহিংসতা একটি বাণিজ্যিক উপকরণে পরিণত হয়েছে। এই বাস্তবতা কেবল নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রেও এক গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দেয়। মুসলিমবিশ^সহ বিশ্বসম্প্রদায়ের উচিত, এই ‘গণহত্যার অর্থনীতি’কে চিহ্নিত করে এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া। নইলে সহিংসতা থেকে মুনাফা তোলার এই নির্মম চক্র আরও বিস্তৃত হবে। আর ভুক্তভোগী হবে নিরীহ, নিষ্পাপ ফিলিস্তিনিরা। এই নির্মম অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী মানবতার জন্য এক বিপজ্জনক নজির হয়ে থাকবে। (সমাপ্ত)
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।