
চিনি-মিষ্টি স্বাদের এই দানাটা কেনা একটা সময় হয়ে ওঠেছিল বাজারের অন্যতম তিক্ত অভিজ্ঞতা। শতক ছড়ানো দাম, সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতা-সবমিলিয়ে চিনি হয়ে ওঠেছিল ভোক্তার দীর্ঘশ্বাস। অবশেষে পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে একশ টাকার নিচে মিলছে চিনি। বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকায়। কিন্তু খুচরা বাজারে দাম কমার লক্ষণ নেই। খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০৫-১১০ টাকায়।
২০২২ সালের অক্টোবরে দেশে প্রথমবারের মতো ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায় চিনির দাম। এরপর এক প্রকার অস্থিরতায় কেটেছে পণ্যটির বাজার। মাঝখানে বিশ্ব বাজারে পণ্যটির দাম কমলেও দেশের চিত্র ছিল ভিন্ন। কয়েক মাস আগে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল।
চিনির দাম কমাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নানা উদ্যোগ নিতে থাকে। শুরুতে গত ৮ অক্টোবর পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনির নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আমদানি ও সরবরাহ বাড়াতে ১৭ অক্টোবর পরিশোধিত চিনি আমদানি শুল্কও কমায় প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট ৫ লাখ মেট্রিকটন চিনি আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সরকারের প্রচেষ্টার ফল মিলতে শুরু করেছে। প্রায় তিন বছর পর চিনির দাম কমায় স্বস্তি ফিরেছে ক্রেতাদের।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, একটা সময় চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপ চিনির বাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতো। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেই পরিস্থিতি নেই। এখন মেঘনা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপের পাশাপাশি অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও চিনি আমদানি করছে। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকায় দামেও প্রভাব পড়েছে।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স জিরি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এখন বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ চিনি আমদানি করছে। এ কারণে চিনির দামে বড় দরপতন হয়েছে।’
খাতুনগঞ্জ আড়তদার সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এহসান উল্লাহ জাহেদী সিন্ডিকেট না থাকার বিষয়টি সামনে এনেছেন। তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে ১৩০-১৩২ টাকায় বিক্রি হতো চিনি। সেটি এখন ৯৫-৯৬ টাকায় মিলছে। বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমার প্রভাব দেশে পড়েছে।’
উৎপাদন বাড়ায় বিশ্ববাজারে কমেছে চিনির দাম: বিশ্বে চিনির সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ ব্রাজিল। সেখানে এবার গত বছরের তুলনায় ৪ শতাংশ পর্যন্ত চিনির উৎপাদন বেড়েছে। একইসঙ্গে চিনির দ্বিতীয় বৃহৎ উৎপাদক ভারত গেল বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে চিনির উৎপাদন ১৯ শতাংশ বাড়ানোর কথা জানিয়েছে। চিনির উৎপাদন ব্যাপকহারে বাড়ায় গত এক বছরের তুলনায় তুলনায় চিনির দাম টন প্রতি কমেছে প্রায় ১০০ ডলার। গত সেপ্টেম্বরে যেখানে প্রতি টন চিনি বিক্রি হয়েছে ৫৭৫ ডলারে এখন তা নেমে এসেছে ৪৭৩ ডলারে। বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমার সুফল মিলছে দেশের বাজারে। দেশে প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। যার প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। গত বছর চিনি আমদানির পেছনে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে।
খুচরায় এখনো ১০৫-১১০টাকা: পাইকারিতে চিনির দাম একশ টাকার নিচে নেমে গেলেও খুচরায় এখনও গুনতে হচ্ছে একশ টাকার ওপরে। অথচ মিলগেট থেকে উত্তোলন, পরিবহন খরচ ও বিক্রেতাদের মুনাফা হিসাবে খুচরায় চিনি বিক্রি হওয়ার কথা ১০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে খুচরা বাজারে স্থান-ভেদে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১০৫-১১০ টাকা পর্যন্ত। গতকাল বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের মুদি দোকানগুলোতে চিনি বিক্রি করা হচ্ছিল ১০৫ টাকায়। তবে দুই নম্বর গেটের কর্ণফুলী কমপ্লেক্সে আরও পাঁচ টাকা বাড়িয়ে চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভোক্তারা।
কর্ণফুলী কমপ্লেক্সে বাজার করতে আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শামসুল ইসলাম বলেন, ‘পাইকারি বাজারের চেয়ে খুচরায় প্রতি কেজি চিনিতে ১৫ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে। অথচ পার্থক্যটা ৫ টাকার বেশি হওয়ার কথা ছিল না। সরকারি সংস্থাগুলোর পাইকারি বাজারের পাশাপাশি খুচরা বাজারেও তদারকি করা দরকার। তাহলে মানুষ প্রকৃত সুফল পাবে।’
পূর্বকোণ/ইবনুর