
চট্টগ্রাম নগরীর আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের নিচে পড়ে থাকা মৃত্যুপথযাত্রী এক প্রবীণকে উদ্ধার করতে এসেছিলেন পাঁচ তরুণ। দুই নম্বর গেট এলাকায় সেই উদ্ধার কাজ করার সময় হঠাৎ তাদের নজরে পড়ে ফ্লাইওভারের নিরাপত্তা বেষ্টনী (রেলিং) নড়াছড়া করার আওয়াজ। গিয়ে দেখেন-হেলে পড়া একটি রেলিং ভাঙার চেষ্টা করছেন একজন। এরপর তারা ওই লোককে ধরে পাশের পুলিশ বক্সে নিয়ে যান। ঘটনাটি ছিল গত মঙ্গলবার দুপুরের।
এ তো গেল রেলিং চুরির চেষ্টার সময়ে জনতার চোর ধরার প্রচেষ্টা। শুধু রেলিং নয়, ফ্লাইওভারের ওপরের অংশের স্টিল গার্ডারের নাটবল্টু-লোহাও চুরি হচ্ছে। রেলিং চোর ধরার পরদিন গত বুধবার নাট-বল্টু-লোহা চুরির সময় তিনজনকে ধাওয়া দিয়ে ধরে জনতা। চোরেরা দুই নম্বর গেট এলাকায় ফ্লাইওভারের স্টিল গার্ডার থেকে নাটবল্টু খুলছিল। বিষয়টি নজরে এলে স্থানীয়রা এগিয়ে এসে ধাওয়া দেন। পরে ধস্তাধস্তি করে তিনজনকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন তারা।
এই চোরদের বেশিরভাগই মাদক সেবনের সঙ্গে যুক্ত। তাদের হাতে ছুরিসহ নানা দেশীয় অস্ত্র থাকে। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চোর ধরতে এগিয়ে আসছে জনতা। কিন্তু যাদের বেষ্টনী ও নাটবল্টু রক্ষণাবেক্ষণের কথা, সেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) যেন লম্বা ঘুমে আছে।
প্রতিবছর অন্তত একবার আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের সার্বিক পরিস্থিতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার করার কথা থাকলেও নির্মাণের পর গত সাত বছরে একবারও তা করেনি চসিক। এর মধ্যে গত বছর থেকে এই ফ্লাইওভারের রক্ষণাবেক্ষণের কাজও হচ্ছে না। এই সুযোগে স্টিল গার্ডার থেকে নাট-বল্টু খুলে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। ফ্লাইওভারের নিচে সবুজায়নের জন্য তৈরি করা নিরাপত্তা বেষ্টনীও চুরি হচ্ছে। এতে প্রায় ৯০ হাজার গাছ নষ্টের পথে রয়েছে।
গত মঙ্গলবার রেলিং চুরির সময়ে এক ব্যক্তিকে ধরা তরুণদের মধ্যে ছিলেন নজরুল ইসলাম জয়। এই তরুণ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘একটা রেলিংয়ে ধাক্কাধাক্কি করে বাঁকা করে ফেলে ওই ব্যক্তি। পরে সেটিকে ভাঙার চেষ্টা করছিলেন। তাকে দেখে মনে হয়েছে ড্যান্ডি সেবনের সঙ্গে জড়িত। পরে আমরা তাকে দুই নম্বর গেটের পুলিশ বক্সে নিয়ে যাই। কিন্তু মাদকাসক্ত হওয়ায় তাকে রাখতে রাজি হয়নি পুলিশ। পরে আমরা হতাশ হয়ে চলে আসি।’
ওই ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। সেখানে অনেকেই নানা মন্তব্য করেন। একজন লেখেন, ‘প্রশাসন এসব চুরি করার সুযোগ করে দিয়েছে। হয়তো তারা চায় এগুলো নিয়ে গেলে, নতুন কাজের টেন্ডার হবে তাতে অনেকের ব্যবসা হবে। আর আমরা বেকুব জনগণ এসব দেখলে প্রতিবাদ করি, দেশের সম্পদ চুরি হচ্ছে বলে।’
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলাইমান দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমরা এই বিষয়ে তৎপর আছি। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা সার্বক্ষণিক ফ্লাইওভারে নজরদারি করা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কেননা আমাদের টহল টিম এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে টিমকে নানা জায়গায় মুভমেন্ট করতে হয়। এরপরও আমরা গত এক মাসে ফ্লাইওভারের রেলিং-নাট-বল্টু চুরির ঘটনায় ১৮ জনকে আটক করে মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠিয়েছি।’
নাম প্রকাশ না করে পুলিশের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ফ্লাইওভারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চসিকের। তাদের সহযোগী হয়ে কাজ করতে পারে পুলিশ। কিন্তু চসিকের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। তারা চুরির ঘটনায় কোনো মামলাও করে না। এখন পুলিশ তো এসব ঘটনায় নিজে বাদী হয়ে মামলা করতে পারে না। সেজন্য দেখা যায় আসামি ধরে জেলে পাঠানো হলেও, কিছুদিন পর তারা বেরিয়ে এসে পুনরায় চুরিতে জড়াচ্ছে।’
৬৯৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এরপর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চসিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ফ্লাইওভারটি বুঝে পাওয়ার পর সৌন্দর্যবর্ধন ও এর রক্ষণাবেক্ষণে ট্রেড ম্যাক্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে দেশের পট পরিবর্তনের পর এই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ট্রেড ম্যাক্সের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে চসিক। এরপর গত ১৮ জুন মেসার্স দেলোয়ার এন্টারপ্রাইজ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। তবে ট্রেড ম্যাক্স মামলা করায় আইনি জটিলতা তৈরি হওয়ায় এক বছর ধরে অরক্ষিত অবস্থায় আছে গুরুত্বপূর্ণ এই অবকাঠামো।
তবে ফ্লাইওভারের রেলিং-নাটবল্টু চুরির বিষয়ে গত মাসের ২৮ তারিখ তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছিল চসিক। কমিটির প্রধান চসিকের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (সিনিয়র সহকারী সচিব) উম্মে কুলসুম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমরা ফ্লাইওভার পরিদর্শন করেছি। পর্যবেক্ষণের পর সুপারিশও আমরা প্রস্তুত করেছি। ইতিমধ্যে আমাদের মেয়র মহোদয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যতটুকু সতর্কতা দরকার সিডিএ’র সঙ্গেও কথা বলেছি।’
কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে এখন পর্যন্ত চসিকের পক্ষ থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সেই সুযোগে বন্ধ নেই বেষ্টনী-নাট বল্টু চুরির ঘটনাও।
পূর্বকোণ/ইবনুর