চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

জুলাই বিপ্লব ও নিউ ব্রান্সউইকের বাংলাদেশি

জুলাই বিপ্লব ও নিউ ব্রান্সউইকের বাংলাদেশি

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

৫ আগস্ট, ২০২৫ | ১২:০৬ অপরাহ্ণ

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে বাংলাদেশের জনগণ যারা স্বৈরাচারের বিপক্ষে ছিলেন তাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক এবং স্মরণীয় সময়।

 

‘নিউ ব্রান্সউইক’ কানাডার একমাত্র দ্বিভাষিক প্রদেশ, যার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৮ লক্ষ। এটি কানাডার একমাত্র প্রদেশ যেখানে ইংরেজি ও ফরাসি উভয় ভাষাই সরকারিভাবে স্বীকৃত। নিউ ব্রান্সউইকের চারটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হল: ফ্রেডেরিকটন, সেন্ট জন, মনকটন এবং মিরামিশি।

 

টরেন্টো শহর থেকে ‘নিউ ব্রান্সউইক’ এর দূরত্ব প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার। বিমানে আসতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট। সাধারণত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তুষারপাত হয়।

 

এই প্রদেশে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ বসবাস করেন, যাদের বেশিরভাগই পেশাজীবী। যেমন ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইটি টেকনিশিয়ান, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী ।

 

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই আমরা নিউ ব্রান্সউইকের প্রায় সব বাংলাদেশিরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলাম।

 

প্রতিদিনই আমরা বাংলাদেশের ছাত্রদের ও বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে চিন্তিত থাকতাম। ইউটিউব এবং ফেইস বুকের বিভিন্ন পোস্ট ফলো করা হত এবং এই সংকট কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলতো।

 

সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিবিসি ও আকাশবানীর খবরের কথা আমাদের মনে করিয়ে দিল। কিন্তু বর্তমানের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট এর সাথে ভিডিও ক্লিপিংগুলো অনেক বেশী শক্তিশালী ছিল এবং এই পোস্টের ইম্প্যাক্ট মুহূর্তের মধ্যে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়া শুরু করলো।

 

কিন্ত তার মাঝেও ফ্যাসিস্ট হাসিনার রেজিমের প্রপাগান্ডাভিত্তিক পোস্টও কম ছিলনা। কিন্ত মাস পিপল এর মিলিয়ন মিলিয়ন আপলোডের তোড়ে সরকারী পক্ষের প্রপাগান্ডা বানের পানির তীব্র স্রোতের মতো হারিয়ে গেল।

 

পুলিশী নির্যাতনের মর্মস্পর্শী অমানবিক ভিডিও ক্লিপিংগুলো বাংলাদেশের বেশীর ভাগ মানুষের সাপোর্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহায্য করেছে।

 

অনেকগুলো ভিডিওর ভেতরই ছিল বুকফাটা আর্তনাদ। একটি ভিডিওতে দেখা গেল ১৯-২০ বছরের একজন তরুণের গুলিবিদ্ধ শরীরকে টেনে হিঁচড়ে পুলিশের সাঁজোয়া গাড়ি থেক ছুঁড়ে ফেলার দৃশ্য। সেই শহীদের নাম ছিল ইয়ামিন। উনি ছিলেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি (গওঝঞ) এর কম্পিউটার বিভাগের ছাত্র। তরুণটিকে যখন পিচ-ঢালা সড়কে ফেলে দেওয়া হল তখনও তাঁর শরীরে প্রাণ ছিল, ফুসফুসের উঠানামা স্পষ্ট দৃশ্যমান ছিল। কিছুক্ষণ পর তার নিথর দেহ থেকে প্রাণ উড়ে চলে গেল আসমানে। এই ভাবে শহীদের তালিকা দীর্ঘ হতে শুরু করল। এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮ জুলাই সাভার এলাকায়।

 

আমরা প্রবাসীরা কাজে-কর্মে মন দিতে পারছিলাম না। মনে হতো দেশে থাকলে আমরাও এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অংশীদার হতে পারতাম।

 

প্রতিবাদ সংগঠনের শুরু : আস্তে আস্তে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দাবানলের মত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং যার কিছুটা আঁচ সারা বিশ্বের বাংলাদেশীদের ভেতরও সংক্রমিত হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় আমরাও নিউ ব্রান্সউইক এর বাংলাদেশীরা প্রায় প্রতিদিনই আমাদের ফোন ও মেসেঞ্জার গ্রুপ-এ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছি। এর পরিণতি কি হবে তা নিয়ে আলোচনা করি। এই ভাবে আমরা সবাই মানসিকভাবে ভীষণ চাপের মধ্যে ছিলাম।

১৯ জুলাই ২০২৪ সালের সকালে আমাদের সেইন্টজন বাংলাদেশী কমিউনিটির সবার সাথে ফোনে ও মেসেঞ্জারে গ্রুপের মাধ্যমে আমি এবং আমার স্ত্রী ডা. সৈয়দা মুনজীবা শর্মীন যোগাযোগ শুরু করি এবং ইঞ্জিনিয়ার মুশফিকুর রহমান ইউনিভার্সিটি অফ নিউব্রানসউইক, সেইন্ট জন শাখার বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ করে পোস্টার লেখার আয়োজন করেন। পোস্টারের সরঞ্জাম ডলার স্টোর থেকে কেনা হয়েছিল।

 

কমিউনিটির অন্যান্য সদস্যরা বিশেষ করে যাদের স্কুলে পড়ুয়া ছেলেমেয়ে আছে তারাও হাতে লেখা পোস্টার লিখেছেন। আমরা মেসেঞ্জার গ্রুপ এবং ফোনের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেই যে, আমরা বাংলাদেশের ছাত্র-আন্দোলনের প্রতি আমাদের সমর্থন জানাব এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব।

 

সবাই মিলে লিখা পোস্টারগুলোতে এই শ্লোগানগুলো প্রাধান্য পায় : STOP KILLING STUDENTS , FREE INTERNET IN BANGLADESH, NO CARFEU, We Want Justice For Student killing.

সবাইকে বলা হয় যে, ২১ জুলাই রবিবার আমরা সেইন্টজন সিটি সেন্টারে মিলিত হব এবং আমাদের সলিডারিটি বাংলাদেশ এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করবো।

আমাদের সেইন্ট জন-এ বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটি মেম্বারদের ভেতর উল্লেখযোগ্য এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন প্রফেসর মুশতাক হুসেইন, দীপা হুসেইন, ইঞ্জিনিয়ার সাজ্জাদুল হক, ইঞ্জিনিয়ার লাবনী হক, ডা. মনোয়ার, ডা. ফারাহ নাজ, ডা. এহসান চৌধুরী রানা, ডা. শামীমা হক মিলি,ডা. মোবারক খান পাভেল, ডা. ফাহমিদা বিন্তী, সাদমান রহমান, ডা. মুনজীবা শর্মীন, ইঞ্জিনিয়ার দিব্যেন্দু নাথ, ইঞ্জিনিয়ার লিপিকা নাথ, ইঞ্জিনিয়ার মুশফিকুর রহমান, মোবাশ্বেরা খান, জিয়াউস শামস পরাগ, আমীরা আজহার ইথেন, সাঈদা আখতার কণা, এনামুল হক আনাম, শম্পা পারভীন, মিথুন, অবনী, নাহিদ হোসেন, ফাহমিদা হুদা বাবলি, যেবায়দা জামান শিখা, ব্যাংকার তানভির আহমেদ, আমনা রসুল ঈশিতা আবেদ হোসেন, রুবাইয়া অরিন, কাজী মাহফুজ, তামান্না সেগুফতা তমা, সিবীলী সাবিত্রী, রিয়া সাবিত্রী, স্বপন সাহা, শ্রাবন্তী সাহা, সৈয়দ মোশতাকুর রহমান রাতুল, তানজুন নাহার তানিয়া, মহিউদ্দীন আহমেদ, সিনথিয়া আফরোজ, শ্যানন হুসেন, ইশতিয়াক হুসেন, সাদিক খন্দকার, আলীশা আয়াত, সাফায়েত আহমেদ, ফারজানা হোসেন সুমি, রাহিমা বিনতে মাহবুব, মোহাম্মদ মঈন, ফারজানা আলি লাকী, জোবায়ের ইসলাম, শাহনাজ, ফাহিম, মুজাহিদুল ইসলাম, সাইফুল, শুভ, অনামিকা, ইয়াসীন, আরাফাত, সোহেল শিকদার, ফাহিমা কনা সহ আরো অনেকে।

 

এছাড়াও আমাদের নতুন প্রজন্মের কানাডিয়ান বাংলাদেশী পরিবারের স্কুল এবং ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত ছেলেমেয়েরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন। কানাডিয়ান বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের বাচ্চাদের মধ্যে ছিলেন নিহলা, নিহমা, মিনহা, মার্নিয়া, সিনথিয়া, আরীবা, মাহিরা, তুহান, আদিল, আনায়য়া, আভিয়ানা, আয়মান, রাহিল, মিহু, সুহা, মুত্তাকীন, ফাতিহা, তাহির, আমরিন, আর্শিয়া, মাহিয়াত, মিখাইল, মায়মুনা, মাহাসির, মাহিয়াস, ইলাশ, অরলো, কিয়ান, আলি, রিদা, সিয়াম, সাজিদ, সাফওয়াতসহ আরো অনেকে।

 

মোট কথা, সেইন্ট জনের বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রায় সকল সদস্য পরিবারসহ জুলাই আন্দোলনে সলিডারিটি দেখিয়েছেন।

 

২১ জুলাই আমরা নিউ ব্রান্সউইকের সিটি সেন্টারে একত্রিত হই। প্রায় ১০০ জনের অধিক বাংলাদেশি পুরুষ, মহিলা ও শিশু একসঙ্গে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ করি এবং বাংলাদেশের ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করি। এই ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশ মংটন সিটি ও ফ্রেডেরিকটন সিটির বাংলাদেশীরাও আয়োজন করেছেন।

 

ইতিমধ্যে বাংলাদেশি কানাডিয়ান এসোসিয়েশ অফ নিউব্রানসউইক (ইঈঅঘই) এর পূর্বনির্ধারিত একটি কমিউনিটি সমাবেশের আয়োজন ছিল ফ্রেডেরিকটনের অদূরে একটি পার্কে। সেদিন সমস্ত নিউব্রান্সউইক এর বাংলাদেশীরা একত্রিত হয়ে জোহরের নামাজ আদায়ের পর শহীদদের জন্য প্রফেসর মুশতাক হুসেইন এর পরিচালনায় শহীদদের আত্মার জন্য মাগফেরাত কামনা করে দীর্ঘ মোনাজাত করা হয়।

 

অবশেষে, ৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে একটি সুসংবাদ আসে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে এবং হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়েছে। আমরা আনন্দের সঙ্গে সিটি সেন্টারে আবারো একত্রিত হয়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সাফল্যের জন্য আনন্দ মিছিল করি।

 

এবারের পোস্টারের লেখাগুলো ছিল নিম্নরূপ-
দেশটা কারো বাপের না,
দেশটা কারো মায়ের না,
দেশটা আমাদের

NO MORE DICTATORSHIP,
BANGLADESH
BELONGS TO PEOPLE
NO FAMILY OWNERSHIP


যদিও আমরা আমাদের দেশ থেকে অনেক দূরে থাকি, তবুও আমরা মনে করি, আমরা এখনও আমাদের দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত, আমরা দেশকে ভালবাসি । সুদূর কানাডায় বসেও আমরা প্রতিদিন বাংলাদেশের কথা ভাবি এবং এখানে যেকোনো ভালো কিছু দেখলে সেটি কিভাবে বাংলাদেশে প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়ে ভাবি।

আমাদের প্রতিবাদের সমস্ত ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন আইটি স্পেশালিস্ট খুরশিদ আলি রনি। অনেক কানাডিয়ান আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেন, কী ঘটেছে? আমরা তাদের বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করি। তারাও আমাদের সমর্থন জানান।

 

আমার ধারণা পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে এই ধরনের প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছে।

 

ভবিষ্যতে আমরা আশা করি বাংলাদেশে একটি ভালো সরকার গঠিত হবে, একটি গর্বিত দেশ হয়ে উঠবে এবং বাংলাদেশের সব নাগরিক গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে পারবে। আমরা আর কোনো ফ্যাসিস্ট সরকার চাই না। আমরা একটি মুক্ত, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন চাই।

জয় গণতন্ত্র! বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক। ধন্যবাদ।

 

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, সেইন্ট জন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউ ব্রুান্সউইক। এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসী ইউনিভার্সিটি, কানাডা।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট