চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

একান্ত সাক্ষাৎকারে ডা. আসিফ মুজতবা মাহমুদ

ফুসফুসের রোগ বাড়ছে ৫ কারণে নতুন হুমকি ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’

নিজস্ব প্রতিবেদক

৪ আগস্ট, ২০২৫ | ৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে ফুসফুসের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বায়ুদূষণ, ঘনবসতি, জীবনযাত্রার অনিয়ম, কায়িক পরিশ্রমের অভাব ও ধূমপান- এই পাঁচ বিষয়কে ফুসফুসের রোগী বাড়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইউনাইটেড হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ডা. আসিফ মুজতবা মাহমুদ। এরসঙ্গে তিনি নতুন আপদ হিসেবে দেখছেন ‘মাইক্রোপ্লাস্টিকের নীরব হুমকি’। যা এখন মানুষের ফুসফুস, রক্ত এবং শরীরের গভীরে ঢুকে পড়ছে। আলোচ্য পাঁচটি কারণ অদূর ভবিষ্যতে ফুসফুসজনিত রোগের সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হবে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
পূর্বকোণের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশের খ্যাতনামা চিকিৎসক ডা. আসিফ মুজতবা মাহমুদ এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, লাং ফাউন্ডেশনের দেশব্যাপী পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বায়ুদূষণ, ঘনবসতি, লাইফস্টাইল পরিবর্তন, কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়া ও ধূমপান। এই পাঁচটি কারণই ফুসফুসের রোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, অধূমপায়ী মানুষের মধ্যেও এসব রোগ বাড়ছে।

বায়ুদূষণকে রোগ বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বায়ুদূষণ ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ধোঁয়া, ধূলিকণা ও বিষাক্ত কণা ফুসফুসে ঢুকে স্থায়ী ক্ষতি করছে। ঘনবসতির কারণে শহরের পরিবেশের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। আমরা সবসময় দরজা-জানালা বন্ধ রাখছি, বাতাস চলাচলের সুযোগ নেই। এসির মাধ্যমে জীবাণু ছড়াচ্ছে, আর বাইরে বের হলে দূষণের মুখে পড়ছি।

জীবনযাত্রার অনিয়ম ও কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়া নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আজকের শিশু-কিশোররা মোবাইল-আসক্ত হয়ে খেলাধুলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তরুণদের মধ্যে কায়িক পরিশ্রম কমে যাচ্ছে। এর ফলে তাদের ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমে আসছে। তাই ফুসফুস সুস্থ রাখতে পরিশ্রম করতে হবে, শরীর সচল রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ধূমপান আগের মতোই রয়েছে। কিন্তু আরও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং। তরুণদের কাছে ই-সিগারেট স্টাইল হয়ে দাঁড়িয়েছে, অথচ এটি ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি ধূমপানের চেয়েও বেশি ক্ষতি করছে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক-আগামী দিনের নীরব ঘাতক: ডা. আসিফ মুজতবা মাহমুদ বলেন, ছোট ছোট প্লাস্টিক কণা ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ এখন আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত প্রবেশ করছে। চোখে দেখা যায় না, ছুঁয়েও বোঝা যায় না। অথচ এগুলো বাতাস, পানি, খাবার ও এমনকি ঘুমের সময়ও ফুসফুসে প্রবেশ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই কণাগুলো রক্তনালী, হৃৎপিন্ড এবং ফুসফুসের ইন্টারস্টিসিয়াম পর্যন্ত পৌঁছে ক্ষতি করছে। এখনই যদি আমরা মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে না আসি, তাহলে আগামী দিনে এটি ফুসফুসের জন্য বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াবে।

অজানা ভাইরাসের আতঙ্কও রয়েছে: চলতি বছর ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পাশাপাশি ঘরে ঘরে জ্বর দেখা দিচ্ছে। এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি এটি কোন ভাইরাস। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন কোনো অচিহ্নিত ভাইরাস ছড়িয়েছে। দ্রæত গবেষণা শুরু করতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

শ্বাসকষ্টে বিপদে আছেন অধিক ঝুঁকিপূর্ণরা: ডা. আসিফ বলেন, যাদের আগে থেকেই শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি কিংবা দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া প্রাণঘাতী হতে পারে। নিয়মিত কাশি, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, বুকে চাপ, রাতে ঘুমের সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসা- এ ধরনের লক্ষণ দেখলে দ্রæত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

ঘরেই শুরু করতে হবে ফুসফুসের যত্ন: ডা. আসিফ বলেন, আমরা ঘরবন্দী হয়ে যাচ্ছি। দরজা-জানালা বন্ধ রেখে এসির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এতে ঘরের বাতাস দূষিত হয়ে যায়। দরজা-জানালা খুলে বাতাস চলাচলের সুযোগ দিতে হবে। গ্রামে থাকা মানুষদের নিয়েও তিনি বলেন, লাকড়ির চুলার ধোঁয়া ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। তাদেরও সাবধান হতে হবে। শিশুদের জন্য বিশেষ পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, শিশুদের মোবাইল আসক্তি কমাতে হবে, তাদের খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ধূলিকণা, ছত্রাক, ঠান্ডা জনিত সমস্যা থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে।

ফুসফুসের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় নতুন প্রযুক্তি : বর্তমানে পালমোনারি ফাংশন টেস্ট (চঋঞ), ফ্লেক্সিবল ব্রঙ্কোস্কপি ও উন্নত ইমেজিং প্রযুক্তির ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই প্রযুক্তিগুলো ফুসফুসের রোগ নির্ণয়ে কার্যকর। ইউনাইটেড হাসপাতালেও এসব সুবিধা রয়েছে। এছাড়া আধুনিক ইনহেলার ও উন্নত ডোজার ব্যবহারের ফলে রোগীদের চিকিৎসা সহজ হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছাড়া ফুসফুসের স্বাস্থ্য রক্ষা পুরোপুরি সম্ভব নয়: ডা. আসিফ বলেন, ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধে ব্যক্তি সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সবচেয়ে জরুরি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে লাং হেলথ কর্নার সচল করতে হবে। স্কুল হেলথ কার্যক্রমকে শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি বায়ুদূষণ কমানোর জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।তিনি বলেন, আমরা অসুস্থ হলে হাসপাতালে যাই, কিন্তু সুস্থ থাকার জন্য কী করা উচিত, তা নিয়ে ভাবি না। ফুসফুস সুস্থ রাখতে হলে সবাইকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে সচেতন থাকতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট