
চিটাগং শপিং কমপ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে আঙুলের কড়িতে কি যেন গুনছিলেন আবদুল হাকিম। মধ্যবয়সী এই মানুষটির কপালে ভাঁজ, চোখে দীর্ঘশ্বাসের ছাপ। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে খানিক বিরক্ত হয়েই বলে ওঠেন, ‘তিন মাস আগে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের এই অংশের নিচে দেখেছিলাম পাঁচটা বেষ্টনী (রেলিং) নেই। এখন এসে দেখি, চুরি হওয়া রেলিংয়ের সংখ্যা আর গুণে শেষ করা যাচ্ছে না!’
হাকিমের ক্ষোভের বাঁধ যেন খুলে যায়। বলতে থাকেন, ‘এতগুলো বেষ্টনী চুরি হয়ে গেলো, সবাই যেন চেয়ে চেয়ে দেখলো। কেউ কিছু বললো না, করলো না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এই ফ্লাইওভারটা যেন এতিম! রক্ষণাবেক্ষণের মমতা থেকে বঞ্চিত। প্রশাসনের এই নীরবতা কি কেবল উদাসীনতা, নাকি গভীর ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি? ফ্লাইওভার থেকে লোহা খুলে নিলেই বুঝি সবার ঘুম ভাঙবে?’
আবদুল হাকিমের ক্ষোভ কোনো ব্যতিক্রম ঘটনা নয়, বরং শহরের অনেক নাগরিকের মনেরই প্রতিধ্বনি। কেননা, মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত ৫ দশমিক ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৫৪ ফুট চওড়া আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের বিভিন্ন অংশ থেকে গত এক বছরে চুরি হয়ে গেছে প্রায় ৪০০টি বেষ্টনী। বেষ্টনী চুরি যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি তো হলোই। পথচারীদের চলাচলে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের ঝুঁকি। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য লাগানো গাছগুলোর ইতোমধ্যে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। ফাঁক গলে বেড়ে উঠছে অস্থায়ী ঘরবাড়ি, যেগুলোর অধিকাংশই নানা অপরাধে জড়িয়ে থাকা ‘গাম পার্টির’ দখলে। আরও বিপজ্জনক বাস্তবতা হলো বেষ্টনী না থাকায় ছিনতাইকারীরা এখন সহজেই ফ্লাইওভারের এক পাশ থেকে চুরি করে অন্য পাশে সহজেই পালিয়ে যেতে পারছে। নগরবাসী যেখানে চায় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা, সেখানেই ফ্লাইওভারটি যেন হয়ে উঠেছে অপরাধীদের গোপন রাস্তা!
২০১৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর চালু হওয়া এই ফ্লাইওভারটি চট্টগ্রামের সবচেয়ে ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইওভার হিসেবে পরিচিত। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এই ফ্লাইওভারসহ চারটি ফ্লাইওভার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কাছে হস্তান্তর করে। সেই থেকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে চসিক।
চুরি ৪০০ রেলিং: এক বছর আগে জুলাই বিপ্লবের সময় সংঘর্ষ চলাকালীন বেশ কিছু রেলিং হেলে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুদিন বেহাল ছিল। সেই সুযোগে চোরেরা সেই সব রেলিংগুলো চুরি করে নিয়ে যায়। এরপর চুক্তি নিয়ে জটিলতায় গত বছরের ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে এই ফ্লাইওভারটি। এই ফ্লাইওভারের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ট্রেড ম্যাক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০২০ সালে চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি অনুসারে ফ্লাইওভারের ওই অংশের সড়কবাতির বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করত প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের ডিসেম্বরে সেই চুক্তি বাতিল না করে সৌন্দর্যবর্ধনে আবার দরপত্র আহ্বান করে চসিক। এরপর তা নিয়ে আদালতে যায় ট্রেড ম্যাক্স। তখন থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যুতের মিটার রিচার্জ বন্ধ রাখে। এ কারণে বেশ কয়েকমাস ধরে রাতে সড়কবাতি জ্বলেনি ফ্লাইওভারের জিইসি থেকে মুরাদপুর ও ষোলশহর থেকে জিইসি র্যাম্প পর্যন্ত অংশে। এতে সূর্যাস্তের পর থেকেই অন্ধকার হয়ে থাকতো ফ্লাইওভারের ওই অংশটি। সেই সময়েই রেলিং চুরির ‘মহোৎসব’ শুরু করে চোরের দল। প্রায় প্রতি রাতেই তারা রেলিংগুলো উপড়ে কিংবা কেটে চুরি করে নিয়ে যেতে থাকে। বেশিরভাগ রেলিং চুরি হয়েছে মুরাদপুর মোড়, ষোলশহর ও দুই নম্বর গেট মোড় এলাকায়। এর মধ্যে মুরাদপুর মোড়েই ৭৮টি রেলিং চুরি হয়েছে। ষোলশহর থেকে দুই নম্বর গেট পর্যন্ত অংশ থেকে নিয়ে গেছে ১৬০টি রেলিং। বাকি ১৬২টি রেলিং চুরি হয়েছে ফ্লাইওভারের দুই নম্বর গেট থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত অংশ থেকে।
২৮০০ টাকার রেলিং বিক্রি হয় ৮০০ টাকায় : অনুসন্ধানে জানা গেছে চুরির পর রেলিংগুলো কেজি দরে ভাঙারি দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এসব দোকানে প্রতি কেজি লোহা এখন ৪২ টাকা দামে কেনা হয়। মুরাদপুর মোড়ে জুলাই শহীদ স্মৃতিফলক স্থাপন নির্মাণের কাজ চলছে। এজন্য সেখানে চুরি হওয়া রেলিংগুলোর জায়গায় নতুন রেলিং বসানো হচ্ছে। রেলিং স্থাপনের সঙ্গে যুক্ত দুজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি রেলিংয়ের ওজন প্রায় ২০ কেজি। কারখানাগুলোতে মজুরিসহ প্রতি কেজি লোহার হিসেব ধরা হয় ১৪০ টাকা হারে। সে হিসেবে দেখা যাচ্ছে এক একটি রেলিংয়ের দাম পড়ছে প্রায় ২ হাজার ৮০০ টাকা। চোরেরা সেই রেলিংগুলো ভাঙারি দোকানগুলোতে বিক্রি করছে ৮০০ টাকায়। মুরাদপুর, ষোলশহর, দুই নম্বর গেটের আশপাশের ভাঙারি দোকানগুলোতে রেলিংগুলো বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে মুরাদপুর ও ষোলশহর স্টেশন এলাকার দুটি ভাঙারি দোকানে গেলে দোকানিরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে নাম প্রকাশ না করে তাঁরা বলেন, ‘ফ্লাইওভারের চুরি হওয়া রেলিং আমরা কিনি না। হয়তো দূরের ভাঙারি দোকানগুলোতে বিক্রি করে চোরেরা। তবে রেলিংগুলো উপড়ে ফেলার পর টুকরো টুকরো করে ভেঙে বিক্রি করতে আনলে তো আর আমাদের কিছু করার থাকে না। কেননা তখন তো আর রেলিংয়ের অস্তিত্ব থাকে না।’
১০ লাখ টাকার ওপর ক্ষতি: প্রায় ৪০০টি রেলিং চুরি যাওয়ায় ১০ লাখ টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে চসিকের। কেননা একটা রেলিং ২৮০০ টাকা হিসেব করলে ৪০০টি রেলিংয়ের দাম দাঁড়ায় ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা। চসিকের কয়েকজন কর্মকর্তাও এমন ক্ষতি হতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন। তবে চসিক এখনো রেলিং চুরি ও ক্ষতির বিষয়ে হিসেব করেনি, ফলে তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। শুধু রেলিং চুরিই হয়নি, নষ্ট হয়ে গেছে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য রোপণ করা গাছও। মুরাদপুর, ষোলশহর, দুই নম্বর গেট এলাকায় বেশি রেলিং চুরি হয়েছে। সেসব এলাকায় গাছের কোনো চিহ্নও নেই। এই খাতেও বিপুল পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়েছে চসিক।
ঝুঁকি নিয়ে পারাপার, ছিনতাইকারীদেরও ‘সুবিধা’: রেলিং চুরি যাওয়ায় ফ্লাইওভারের বেশিরভাগ জায়গায় এ পাশ থেকে ওই পাশে যাওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা নেই। ফলে ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপারের ঘটনা বেড়েছে। বিশেষ করে মুরাদপুরে পদচারী-সেতু (ফুটওভার ব্রিজ) ব্যবহার কমে গেছে। কেননা বেশিরভাগ মানুষকেই ব্যস্ত সড়ক দিয়ে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে পারাপার করতে দেখা গেছে। রেলিং না থাকায় ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যও বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগে রাতে ষোলশহরের শপিং কমপ্লেক্স এলাকায় চুরির শিকার হন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শামশুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘টেম্পো-জাতীয় মাহেন্দ্র গাড়িতে চড়ে দুই নম্বর গেট থেকে বহদ্দারহাটের দিকে আসছিলাম। আমার হাতে একটা কাপড়ের প্যাকেট ছিল। গাড়ি একটু জ্যামে পড়তেই মুহূর্তের মধ্যে এক তরুণ এসে ছোঁ মেরে প্যাকেটটি নিয়ে ফ্লাইওভারের রেলিং না থাকা অংশ দিয়ে অন্যপাশে চলে যায়। রেলিং থাকলে হয়তো সে এভাবে পালাতে পারতো না।’
গড়ে ওঠেছে ৭টি অস্থায়ী ঘর : বিভিন্ন অপারাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা রেলিং না থাকার সুযোগে ফ্লাইওভারের নিচে চারপাশে কাপড়-ত্রিপল দিয়ে অস্থায়ী ঘর বানিয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেছে। ষোলশহর থেকে দুই নম্বর গেট এলাকা পর্যন্ত অংশে এমন পাঁচটি ঘর দেখা গেছে। এছাড়া দামপাড়া ও ওয়াসা এলাকায় দুটি ঘর রয়েছে। রান্না থেকে প্রাকৃতিক কাজ সারা-সবই চলছে ফ্লাইওভারের নিচে। আবার যারা এখানে থাকছেন তাদের বেশিরভাগকেই গাম সেবন করতে দেখা যায়। রেলিং চুরির সঙ্গে এদেরও হাত থাকতে পারে বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই।
কি বলছে প্রশাসন: রেলিং চুরি নিয়ে শুরু থেকেই সোচ্চার রয়েছেন নগরের সচেতন মানুষেরা। সম্প্রতি রেলিং ও গাছ চুরির প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করেছে জামায়াতও।
বিষয়টি নিয়ে এখন জোরালোভাবে ভাবতে শুরু করেছে চসিকও। চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন সম্প্রতি একটি সভায় বলেছেন, ‘মাদকসেবীরা ফ্লাইওভারের রেলিং, নাট, ডাস্টবিনসহ বিভিন্ন জিনিস চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। এই বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আমরা পুলিশকে চিঠি দেব।’ পুলিশকে চসিক থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে চোরদের ধরার ব্যাপারে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছে। আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের বেশিরভাগ অংশই পড়েছে পাঁচলাইশ থানা এলাকায়।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলাইমান পূর্বকোণকে বলেন, ‘ফ্লাইওভারের রেলিংসহ বিভিন্ন জিনিস চুরির সঙ্গে জড়িতদের ধরতে আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। এখন পর্যন্ত এসবের সঙ্গে জড়িত ১০জনকে আটক করা হয়েছে।’ এখন দেখার বিষয়-ফ্লাইওভারের বাকি রেলিংগুলো রক্ষা করা যায় কিনা। নাকি অবহেলায় সেগুলোও যাবে-চোরের কব্জায়।
পূর্বকোণ/ইবনুর