চট্টগ্রাম রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

বাজারে সবকিছুরই দাম চড়া
ফাইল ছবি

বাজারের ঝুড়িতে চাপা কান্না !

নিজস্ব প্রতিবেদক

১ আগস্ট, ২০২৫ | ১২:৪২ অপরাহ্ণ

বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা। ব্যাগ হাতে বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারে ঢুকলেন রহিমা বেগম। মধ্যবয়সী এই নারী কয়েক কেজি চাল, কিছু মাছ, আর কয়েকপদের সবজি কিনবেন-যতটুকু হলে কদিন চলে। কিন্তু কয়েকটি দোকান ঘুরেই এই গৃহবধূ বুঝে যান-ঝুড়িভর্তি বাজার নয়, ফিরতে হবে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে। কারণ একটাই-বাজারে বেড়েই চলছে প্রায় সবকিছুর দাম। আর দাম বাড়া মানেই তো মধ্যবিত্তের বলতে না পারা হাহাকার-বোবা কান্না।

 

বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের মুখে পাওয়া গেল রহিমাকে। জানতে চাইলে বলে ওঠেন, স্বামী একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আমরা দু’জন ছাড়া আছে দুই সন্তান। একজনের আয়ে চারজনের সংসার চালাতে এমনিতেই হিমশিম খাই। এর মধ্যে সবকিছুরই দাম বেড়ে চলেছে। চাল কিনতে গেলে মাছে টান পড়ছে, মাছ কিনতে গেলে সবজিতে। দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কিন্তু আমরা মধ্যবিত্তরা তো কষ্ট দেখাতেও পারি না।

 

রহিমার কথার প্রমাণ পাওয়া গেল বাজারের ভেতরে ঢুকে। মাছ থেকে মুরগি, সবজি থেকে গরুর মাংস, চাল থেকে ফলের বাজার-সবখানেই শুধু দাম বাড়ার গল্প। আগের সপ্তাহের চেয়ে অনেক পণ্যেরই দাম বেড়েছে। দাম বাড়ার এই হার ক্রমাগত দেখা যাচ্ছে গত একমাস ধরে। শুধু এই বাজারে নয়-দাম বাড়ার এই চিত্র দেখা গেছে চকবাজার ও কর্ণফুলী কমপ্লেক্স কাঁচাবাজারেও। ক্রেতা আর খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন-গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের পর বাজার থেকে সিন্ডিকেট দূর হয়েছিল। প্রশাসন-ছাত্রদের তদারকিতে বাজারে প্রায় সব পণ্যেই ন্যায্য দামে বিক্রি শুরু হয়েছিল। এতে স্বস্তি ফিরেছিল নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ঘরে। কিন্তু নগরীর বাজারগুলোতে বেশ কয়েকমাস ধরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেখা মিলছে না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানও বন্ধ রয়েছে। এই সুযোগে সিন্ডিকেট করে ‘যেমন ইচ্ছে তেমন দামে’ পণ্য বিক্রি আবারও শুরু হয়েছে।

 

কাঁচাবাজারগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, আলু ছাড়া বেশিরভাগ সবজিই ৫০-৬০টাকার ওপরে। বরবটি তো ১০০ ছুঁয়েছে। বাজারগুলোতে বস্তায় বস্তায় মরিচ থাকলেও দাম কমার যেন কোনো লক্ষণ নেই, বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৬০টাকায়। পেঁয়াজও ৫-১০টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০টাকায়। টমেটোও সেঞ্চুরির ওপরে-১৪০ টাকা। শুধু আলুটাই ২০-২৫টাকায় মিলছে।

 

মাছ বাজারে ঢুকে ইলিশের দিকে তাকানো যেন মানা। ভরা মৌসুম চললেও ইলিশ এখনো স্বপ্ন! আকারভেদে প্রতি কেজি ১২০০ থেকে ২৪০০টাকায় বিক্রি হচ্ছে জাতীয় মাছ। যে ছোট চিংড়ি দিয়ে তরকারি রান্না করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষেরা, সেটিরও দাম বেড়ে -৭০০ থেকে ৮০০টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি। বড় চিংড়ির নাগাল পাওয়াও দুঃসাধ্য-প্রতি কেজি ৯০০-১৪০০টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। জীবন্ত রুই-কাতলা মিলছে না ৪০০ টাকার নিচে। অবশ্য তেলাপিয়া, পাঙ্গাসটা আগের দামে পাওয়া যাচ্ছে ২২০-২৮০টাকায়।

 

বোরো মৌসুম শেষ হচ্ছে, তবে চালের দাম কমেনি বরং বেড়েছে কয়েক দফায়। অনেকে বলছেন ধানের ফলন ব্যয়ের কারণে এমনটা হয়েছে। আবার অনেকে বলছেন মিলারদের কারসাজির কারণেই এ অবস্থা। বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজিতে। আটাশের দাম কেজিপ্রতি ৬৫ টাকা। মধ্যম মানের নাজিরশাইল-মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা কেজিতে। ভালো মানের কাটারি নাজিরশাইল এবং মিনিকেটের কেজি ক্ষেত্র বিশেষে ৮৫-৯০ টাকা। বেশিরভাগ ৫০ কেজির চালের বস্তায় দাম বেড়েছে ৩৫০-৫০০ টাকা পর্যন্ত।

 

ফলের টুকরো যেন গরিবদের পাত থেকে উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমের দাপটে গত দুই মাসে অন্য সব ফলের দাম অনেকটাই কম ছিল। এখন আমের মৌসুম শেষের দিকে। ফলে এখন একদিকে বাজার থেকে ‘কম দামের’ আম কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়া শুরু করছে আনারস, পেয়ারা, আপেল, ড্রাগন, মাল্টার মতো প্রচলিত ফলগুলোর দাম। বিশেষ করে মাল্টা স্মরণকালের সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে। ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ায় চাহিদা বাড়ায় এই ফলটি বিক্রি হচ্ছে ৪৫০টাকায়। একই কারণে মাঝারি আকারের একটি ডাব মিলছে না ১৪০টাকার নিচে।

 

আফসোস নিয়ে রিকশাচালক আবদুল হাকিম তাই বললেন, পাঁচ বছরের ছেলেটার কদিন ধরে জ্বর। মাল্টা খাওয়ার আব্দার করেছিল। কিন্তু বাজারে এসে দেখি ফলটি বিক্রি হচ্ছে ৪৫০টাকায়। দুটার দাম পড়ে গেলো ১৭০টাকা। সারাদিনে আয় করি আর ক টাকা, দুটা ফলেই যদি এত টাকা চলে যায় মাছ-সবজি-তেল কিনি কি দিয়ে?

 

ভোক্তাদের সার্থ রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বাজারে সবকিছুর দাম বাড়া নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এক পক্ষ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে ও আরেক পক্ষ কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায় তা নিয়ে ব্যস্ত। সেজন্য কারো সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে কিছু করার কোনো সদিচ্ছা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। বাজারে নি¤œ ও মধ্যবিত্তের চাপা কান্না বাড়লেও কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না।

 

তবে বাজারে তদারকি বন্ধের কারণ জানতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ এবং সহকারী পরিচালক রানা দেব নাথকে ফোন করা হলেও পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আনিছুর রহমানের নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট