
চট্টগ্রামে এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে সদ্য বিদায়ী জুলাই মাসে। বেড়েছে এডিস মশার ঘনত্ব, সেই সঙ্গে মৃত্যুর মিছিল। শুধু জুলাই মাসেই ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৭ জন। যা গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় সাত গুণ বেশি। আর আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৩০ জন, যা চলতি বছরের জুন মাসের তুলনায় প্রায় আড়াইগুণ বেশি। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৭৫ জন, মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। এর মধ্যে জুলাই মাসেই ভর্তি হয়েছেন প্রায় অর্ধেক রোগী ৪৩০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের। যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৭৮ শতাংশ। এরমধ্যেই জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ডেঙ্গুতে মারা গেছে সীতাকুণ্ডের ১৩ বছরের শিশু আশরাফুর রহমান নয়ন। সীতাকুণ্ডের ফকিরহাট এলাকার কিশোর নয়ন মৃত্যুর তিনদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হন। সীতাকুণ্ড জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বুধবার মারা যায় এ কিশোর। এই এক মাসে এমন সাতটি পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুর রব বলেন, জ্বর কমে যাওয়ার পর অনেকেই ধরে নিচ্ছেন রোগ শেষ, অথচ বিপদ আসছে তখনই। শিশুদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুনে যেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৭৬ জন, সেখানে জুলাইয়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩০ জনে। মৃত্যু যেখানে জুনে ছিল ‘শূন্য’, সেখানে জুলাই মাসেই মৃত্যু ৭ জনের। অগাস্টে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা।
এদিকে, চিকুনগুনিয়ার চিত্র আরও বিস্ময়কর। সরকারি হিসাবে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৪৪ জন ছাড়িয়েছে। এরমধ্যে গত ৮ দিনেই (২২ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত) শনাক্ত হয়েছে ৪৭০ জন। গতকাল নতুন করে শনাক্ত হয় আরও ৬০ জন। তবে ২২ জুলাইয়ের আগের রোগীদের বিস্তারিত পরিসংখ্যান এখনও স্বাস্থ্য দপ্তরের কাছে নেই।
তবে চিকিৎসক ও ল্যাবের তথ্য বলছে- বাস্তব সংখ্যা তার চেয়েও অনেক বেশি। কারণ অধিকাংশ পরীক্ষায় ‘পজিটিভ’ আসছে, এমনকি পরীক্ষা ছাড়াই উপসর্গের ভিত্তিতে অনেককে চিকুনগুনিয়া রোগী হিসেবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ এবার অনেক বেশি। আমাদের কাছে যে রোগীরা আসছেন, তাদের ৮০ শতাংশের উপসর্গ চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। অনেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভয়াবহ সংক্রমণের কেন্দ্রে আছে এডিস মশা। জুলাই মাসেই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের জরিপ চালিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব বিভাগ আইইডিসিআর। জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ এলাকায় লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি। যা একটি এলাকায় ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণের পূর্বাভাস। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নির্মাণাধীন ভবন ও আবাসিক এলাকায় জমে থাকা পানিতে লার্ভার উপস্থিতি বেশি। এর আগের বছরে জরিপ চালায় সিভিল সার্জন কার্যালয়।
দুই জরিপের তথ্যে দেখা যায়, চট্টগ্রামে বাসাবাড়িতে এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি আগের বছরের তুলনায় ১১.৪৩ শতাংশ বেড়েছে। লার্ভা ঘনত্বের গড় হার এখন ৭৫ শতাংশেরও বেশি, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার (২০%) তিন গুণ। কিছু এলাকায় এই হার ১৩৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
জরিপ পরিচালনাকারী ওমর কাইয়ুম বলেন, প্রতিবছর আমরা একই দৃশ্য দেখছি- লিফটের নিচে, ছাদে, ড্রামে, ফ্লাওয়ার টবে জমা পানিতে লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। এসব স্থান আগেও চিহ্নিত ছিল, এখনো আছে। এর মানে হচ্ছে, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে গৃহীত হয়নি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মশক ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম বলেন, নিয়মিতই আমরা ওষুধ ছিটানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তবে জরুরি হয়ে উঠেছে জনগণের সচেতনতা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এখনই তিনটি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, ঘরোয়া ও আশপাশে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জ্বর হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। তৃতীয়ত, এডিস মশার বিস্তার ঠেকাতে সামাজিকভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে।
পূর্বকোণ/ইবনুর