
কেউ হারিয়েছেন সন্তানের কোমল মুখ, কেউবা ভাইয়ের ভরসার হাত, আবার কেউ কেউ প্রাণের বন্ধুকে। তাদের কেউ ডুবে গেছে দিঘির গহীনে, কেউ হারিয়ে গেছে বিশাল সমুদ্রের অতলে। এ যেন শুধু একটি দেহের বিলীন নয়, ডুবে গেছে এক একটি ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন-সজ্জিত সংসার আর আশাভরা পথচলা। তবে তারা হারিয়ে গিয়েও যেন ফুরিয়ে যাননি! শোকে স্তব্ধ হয়েও যে বসে থাকেননি তাদের স্বজনেরা। বরং সেই বেদনায় চূর্ণ হৃদয়েই তারা গড়ে তুলেছেন নতুন এক প্রত্যয়। বুকে আপন মানুষটি হারানোর কান্না চাপা দিয়ে তারা নেমেছেন অন্যের প্রিয়জনকে বাঁচানোর আন্দোলনে।
পানিতে ডুবে স্বজন হারানোদের উদ্যোগে চট্টগ্রামে গড়ে ওঠেছে একটি সংগঠন। যার নাম-‘ড্রাউনিং প্রিভেনশন অ্যালায়েন্স, চট্টগ্রাম’। এর মধ্যেই এই সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। এই মানুষগুলো এখন ছুটে চলেছেন জনে জনে, সচেতনতা ছড়াচ্ছেন, যাতে আর কেউ না হারায় পানির গভীরে।
এই সংগঠনের উদ্যোক্তা ৪০দিন আগে নিজের একমাত্র ছেলেকে হারানো প্রকৌশলী মো. আনোয়ার কবির। গত ১৪ জুন ছয় বন্ধুকে নিয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সহস্রধারা ঝরনায় বেড়াতে গিয়েছিল তার সন্তান মো. তাসিন আনোয়ার। ঝরনার সামনে জমে থাকা পানিতে নেমে তাসিন হারিয়ে যায় স্রোতের গহ্বরে। পরে তার মরদেহ পাওয়া যায়। বুকের ধনকে হারিয়ে আনোয়ার কবিরের হাসি যেন চিরদিনের জন্য উবে গেছে। সেই শোক নিয়েই এই মাসের শুরুর দিকে তিনি পানিতে পড়ে মৃত্যু থামাতে সচেতনতা বাড়াতে একটা সংগঠন খুলতে আগ্রহী হন। যোগাযোগ করেন আরও যারা পানিতে ডুবে সন্তান-বন্ধু-স্বজন হারিয়েছেন তাদের সঙ্গে। তাদের কাছে তুলে ধরেন মনের কথা। এরপর ওই মানুষেরাও তার সঙ্গে যুক্ত হোন। এভাবেই বাড়তে থাকে সংগঠনের পরিধি।
জানতে চাইলে প্রকৌশলী মো. আনোয়ার কবির বলেন, ছেলেকে হারানোর পর পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টি আমাকে খুব বেশি করে ভাবায়। একটা গবেষণায় আমি দেখেছি পানিতে ডুবে প্রতিবছর আমাদের দেশে ১৯ হাজার মানুষ মারা যান। এর মধ্যে বেশিরভাগই শিশু-তরুণ। অর্থাৎ ১ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষ পানিতে ডুবে প্রতিবছর গড়ে মারা যাচ্ছেন ১৪ হাজার। প্রায় সবাই অসচেতনতার কারণেই মারা গেছেন। একটা সুস্থ-সবল মানুষ পানিতে ডুবে মারা যাবে-এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। সেজন্য ছেলেকে হারানোর পর সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমি এমন একটা সংগঠন খোলার উদ্যোগ নিই।
সংগঠনের উদ্যোগে কি কি করা হচ্ছে-এমন প্রশ্নে আনোয়ার কবির বলেন, আমাদের প্রথম কাজ সবাইকে সচেতন করা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা সেটা করে যাচ্ছি। পাশাপাশি বিভিন্ন সচেতনতামূলক ¯স্লোগানসমৃদ্ধ ব্যানার-ফ্যাস্টুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনেসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সাঁটানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এর পাশাপাশি সাঁতার ও পানিতে সুরক্ষার দক্ষতা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে আমরা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেব, বিভিন্ন সভা-সম্মেলন করবো।
আজ শুক্রবার সারাবিশ^জুড়ে পালিত হবে-‘বিশ্ব পানিতে ডুবা প্রতিরোধ দিবস’। এই দিবসে সংগঠনটি একটি সংবাদ সম্মেলন করে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি প্রশাসনকেও বার্তা দিতে চায়।
আনোয়ার কবির বলেন, পুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যুর পাশাপাশি ইদানিংকালে বিভিন্ন পর্যটন-স্পটে তরুণদের ডুবে মৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। দেশে প্রায় দুই কোটি পর্যটক আছে। কিন্তু পর্যটন স্পটগুলোতে নেই কোনো সচেতনতা আর নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম। আমরা শুরুতে প্রশাসন যেন স্পটগুলোতে এরকম নিরাপত্তা ও সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নেয়-সেটি কার্যকরে কর্মসূচি পালন করে যাব।
বেড়াতে কক্সবাজারে গিয়ে পানিতে তলিয়ে গেছেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের তিন ছাত্র। তাদের মধ্যে দু’জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। দুই সপ্তাহ ফেরিয়ে গেলেও এখনো অরিত্র হাসানের লাশ পাওয়া যায়নি। তার মা-বাবা সন্তানের খোঁজে প্রতিদিন চষে বেড়াচ্ছেন সমুদ্র সৈকতের এখানে-ওখানে। এই তিন বন্ধুকে হারানোর ব্যথা কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না দেওয়ান ইজাজ ফারহান। এই তরুণও যুক্ত হয়েছেন-ড্রাউনিং প্রিভেনশন অ্যালায়েন্স, চট্টগ্রামের সঙ্গে।
জানতে চাইলে ইজাজ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, দিনদিন পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে আমাদের বয়সী তরুণেরা এর শিকার হচ্ছেন বেশি। কিন্তু এভাবে মৃত্যুর বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। অনেকেই ভ্রমণ করতে যান, কিন্তু ওই এলাকা সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না। সেখানেও নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু বলা থাকে না। এখন আবার বন্যার প্রকোপও বাড়ছে। ফলে সাঁতার শিখতেই হবে। এসব বিষয়ে আমরা সচেতন করতে চাই। পাশাপাশি প্রশাসনকেও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে আরও সক্রিয় করতে উদ্যোগ নিতে চাই।
অর্থাৎ এই সংগঠনে যুক্ত হওয়া মানুষগুলো যেন বলতে চান-‘আমরা তো হারিয়েছি চিরতরে…অন্তত তোমার স্বজন যেন ফিরে আসে ঘরে, নিরাপদে।’
পূর্বকোণ/ইবনুর