
প্রযুক্তি বদলে দিয়েছে বহুকিছু। গ্রাম থেকে শহর। কিশোর-তরুণদের আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। কমেছে খেলার মাঠ, বিনোদনের জায়গা। যৌথপরিবার ভেঙে তৈরি হয়েছে এককপরিবার। একই ভবনে বসবাস করা এক পরিবারের কাছে অন্য পরিবার অচেনা। পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতা আর প্রযুক্তির আগ্রাসন তৈরি করেছে নানা সংকটের। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের একটি বড় অংশ জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধে। মাদকাসক্তি, ইভটিজিং, খুনাখুনিসহ নানা অপকর্মে উঠছে তাদের নাম। পশ্চিমা আদলে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং।
শিশু-কিশোরদের অপরাধ কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে পারিবারিক বন্ধন জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা। আমার সন্তানের দিকে আমাকেই নজর দিতে হবে। আপনার সন্তানের দিকে আপনার। এটা অনেক আদিসময় থেকেই চলে আসছে। যার যার সন্তান তার তার সম্পদ। কাজেই নিজের ব্যক্তিগত সম্পদকে আমি কিভাবে নিরাপত্তা দেবো সেটা আমার উপর নির্ভর করে। কর্মব্যস্ত জীবনে অভিভাবকরা নিজসন্তানের কতখানিইবা খোঁজখবর রাখতে পারেন। সকালে সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দিয়ে অভিভাবকরা সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। শহুরে যান্ত্রিকজীবন আমাদের তাই শিখিয়েছে। যার ফলে অভিভাবকরা সন্তানদের প্রাত্যহিক জীবনের খোঁজখবর রাখার বেশি সময় পান না। পরিবারের মা-বাবা উভয়েই কর্মজীবী হলে তো কথাই নেই। আবার গৃহিনীরা গৃহস্থালি কাজের পর সন্তানকে দেখভাল করার মতো কতটুকুইবা সময় দিতে পারেন। তাই সন্তানকে নিয়ে অনেক উচ্চাকাক্সক্ষা থাকা সত্ত্বেও মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে অনেকেই হয়তো পারেন না। সন্তানের পেছনে প্রচুর অর্থব্যয় করেও অনেক অভিভাবকের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
অভিভাবকরা সন্তানের বিকাশের মূলে প্রবেশ না করে কেবল সন্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে প্রতিযোগী মানসিকতায় গড়ে তোলে। অনেকেই সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে হীনম্মন্যতায় ভোগে। আপনার সন্তানের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, আবেগগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য সন্তানের উপযোগী একটি সুষ্ঠু, সুন্দর, নির্মল ও প্রাণবন্ত পরিবেশ দরকার। যে পরিবেশে সে অকপটে সামনে এগিয়ে যেতে শিখবে। অমন পরিবেশ সন্তানের সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশের অনেক অভিভাবকই নিজ সন্তানের প্রতি বেশি যত্নশীল নন। সন্তান কখন কোথায় যায়? কাদের সঙ্গে মেশে? কখন বাড়ি ফেরে? বাড়িতে কতক্ষণ কম্পিউটার, মোবাইল, ট্যাব ইত্যাদি নিয়ে সময় ব্যয় করে? ফেসবুকে কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে? কত ঘণ্টা টিভির সামনে বসে? কী কী অনুষ্ঠান দেখে? লেখাপড়ার প্রতি কতটা আন্তরিক ও মনোযোগী? প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় কেমন রেজাল্ট করছে? রেজাল্ট প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে কি না? কোচিং সেন্টার বা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়লে, সেই শিক্ষক সন্তানকে ঠিকমতো বোঝাতে পারছে কি না? আপনার সন্তান পড়ালেখার চাপ সামলাতে পারছে কি না? এসব বিষয় নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে। লেখাপড়ার বাইরেও যে তার একটা আলাদা জগৎ আছে তার খোঁজখবর রাখাও আপনার জন্য জরুরি। সংস্কৃতি তথা গান, ছবি আঁকা, নাচ, অভিনয়, আবৃত্তি ইত্যাদির প্রতি আপনার সন্তানের আগ্রহ থাকলে তা বিকশিত করার সুযোগ আপনাকেই তৈরি করে দিতে হবে। সন্তানকে উৎসাহিত করতে হবে। খেলাধুলার প্রতি আপনার সন্তানের আগ্রহ থাকলে তাকে সময় দিতে হবে। আপনার সন্তান যদি ভুল কিছু করে তাহলে তাকে শুধরিয়ে দিতে হবে। তবেই আপনার সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশ হতে থাকবে। সন্তান বিপথগামী হলে হতাশা বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে ধৈর্য ধরে সন্তানকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনার সুদৃঢ় প্রচেষ্টা করতে হবে। সন্তান কেবল পরিবারেই নয়, আত্মীয়স্বজন, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্রের কাছেও মনের উপযোগী পরিবেশ আশা করে। তবে সন্তানের প্রারম্ভিক পরিবেশ পরিবার থেকেই দিতে হবে।
পরিবারের পিতা-মাতা যদি সন্তানের সংবেদনশীল মনকে উপলব্ধি করে তাকে সুন্দর পথে এগিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা দিতে পারে, সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ জানতে পারে, তাহলে সেই সন্তান অবশ্যই সোনার মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। ছোটদের মন কাদামাটির মতো নরম। আপনার শিশুসন্তানকে আপনি যেভাবে গড়তে চান, সন্তানও ঠিক সেভাবেই গড়ে উঠবে। সন্তানের ওপর কোনো কারণেই হঠাৎ চটে যাওয়া ঠিক নয়। শিশু ভুল বা অন্যায় করলে রেগে না গিয়ে শান্ত মেজাজে তাকে তার ভুলটি বোঝাতে হবে। আজকের শিশুসন্তান আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সন্তানের সেই সুন্দরতম ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আমরা অভিভাকরা কতখানি আন্তরিক, যত্নবান ও দায়িত্বশীল? কেবল অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমেই সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশ সম্ভব নয়। অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। ব্যস্ততার কারণে বাবা তা না পারলে মাকে বা উভয়ই কর্মজীবী হলে দু’জনকেই সময় ভাগ করে সন্তানকে সময় দিতে হবে। অভিভাবকের সুশিক্ষা ও সচেতনতা সন্তানের জন্যে কলাণকর। কারণ একজন শিক্ষিত মা চটজলদি শিশুর সমস্যা বুঝে উঠতে পারে। শিক্ষিত মায়ের সন্তানদের বিকাশটাও দ্রুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই বলে যে, নিরক্ষর মায়ের সন্তানদের সুষ্ঠু বিকাশ হয় না, তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশে অসংখ্য নিরক্ষর মায়ের সন্তান আছে যারা দেশের সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজসহ শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছে। সন্তানের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থের ভিত্তিমূল তৈরি হয় শৈশবকাল থেকেই। একজন নবজাতক শিশুর প্রতি জন্মের প্রারম্ভ হতেই যত্নবান হতে হয়। সন্তানের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার মৌলিক চাহিদা ও অধিকারের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সন্তান যে পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছে সেই পরিবেশ ও প্রতিবেশ সার্বিকভাবে তার বসবাসের সহায়ক কি না সে দিকে সুদৃষ্টি রাখতে হবে। সন্তানের সুষ্ঠু শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে তার স্বাস্থ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশের প্রতি অভিভাবকদের মনোযোগী হতে হবে। আপনার সন্তানের সামগ্রিক বিকাশ ও সামাজিক অবস্থান যথাযথ হচ্ছে কি না তা আপনাকেই নির্ণয় করতে হবে। সন্তানকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষাও দিতে হবে।
সন্তানকে শিষ্টাচার শিক্ষা এমনভাবে দিতে হবে যেন সে তার শিক্ষক ও গুরুজনদের সম্মান এবং শ্রদ্ধা করতে শেখে। সন্তানের ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকাশের দিকে সতর্ক ও সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। সন্তানের সুস্থ ও সবলভাবে বেঁচে থাকার জন্য সুষম খাদ্য অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের মতো দারিদ্র্যপীড়িত দেশে সিংহভাগ শিশুরই সুষম খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারে না পরিবারগুলো। ফলে ক্যালরি সম্পন্ন খাদ্য না খেয়ে জীবনের বিভিন্ন সময় রোগাক্রান্ত হয়। রোগ প্রতিরোধক শক্তি কমে যায়। যা সন্তানের সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিনোদন আপনার শিশু সন্তানের বিকাশে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। বিনোদন শিশুর মানসিক অবস্থাকে আনন্দময়, গতিশীল ও প্রাণবন্ত করে তোলে। যদিও আমাদের শহরে পর্যাপ্ত বিনোদনের সুবিধা নেই তথাপি এর মধ্যেই যতখানি সম্ভব শিশুদের বিনোদনের সুযোগ করে দিতে হবে। কেননা এই বিনোদনের মাধ্যমেই আপনার সন্তান অবারিত মেলামেশার সুযোগ পায়। তা থেকে তার মধ্যে এগিয়ে যাওয়ার মনোভাব গড়ে ওঠে। পাশাপাশি সে বেড়ে ওঠা ও বড় হওয়ার মানসিক প্রেরণা পায়। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে মানুষ যেমন খুব সহজেই অনেক শিখতে, জানতে ও বুঝতে পারছে তেমনি আমাদের সন্তানরা কম্পিউটার, ট্যাব বা স্মার্টফোনে নিয়ন্ত্রণহীন গেমস খেলে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় বিমুখ হয়ে পড়ছে। তাছাড়া ইন্টারনেটে আপত্তিকর ও অশালীন ছবি দেখে সন্তানের মধ্যে এক ধরনের অনৈতিক প্রবণতা গড়ে উঠতে পারে। সন্তান বেড়ে ওঠার পাশাপাশি তার মধ্যে এক ধরনের আবেগ তৈরি হয়। সামাজিক, পারিপার্শ্বিক, পারিবারিক প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনা থেকে শিশুর মনে যে আবেগ সঞ্চিত হয় তা স্বাভাবিক মাত্রায় ধরে রাখতে পারলে শিশুর জীবনে সফলতা অনিবার্য। একটা নিয়ন্ত্রিত আবেগ শিশুর জীবন গঠনে যথার্থ ভূমিকা পালন করে। সন্তানের বলিষ্ঠ বিকাশ হলে সন্তান পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সন্তানের মনোযোগ বাড়ানোর জন্য সন্তানের প্রতি নজর দিতে হবে। কৌশলে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। আপনার সন্তান যদি কোনো কিছু দেখার সময়, পড়ার সময় এবং শোনার সময় দৃঢ় মনোযোগী হতে পারে তাহলে অবশ্যই তার মেধার বিকাশ যথার্থ হবে।
সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে পিতামাতার আকাঙ্ক্ষা হতে হবে বাস্তবধর্মী। সন্তানের বিকাশ সিংহভাগ নির্ভর করে মা-বাবার ভালোবাসা, আদর-যত্ন, প্রেরণার ও দেখভালের ওপর। তাছাড়া পারিবারিক পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ও আনন্দময় হতে হবে। সন্তানের সামনে কথাবার্তায় কখনোই অশিষ্ট হওয়া যাবে না। সুশৃঙ্খল ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে সে নিয়মানুবর্তী হয়ে গড়ে উঠবে। সন্তানের প্রতি নজর রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের ভেতরে পরে। তাই বাবা মায়ের উদ্দেশ্যে একটাই মেসেজ থাকবে সন্তানের সঙ্গে মিশুন, তার কথা শুনুন এবং আপনার ব্যক্তিগত কিছু সুখ দুঃখের গল্প বা বিষয় বন্ধুসুলভ আচরণ নিয়ে শিক্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করুন। এতে করে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের আস্থা ও বিশ্বাস বাড়বে। একইসঙ্গে আপনার সন্তানের যদি ব্যক্তিগত কোনো অভাব, আকাঙ্ক্ষা, না পাওয়ার বেদনা, ক্ষোভ থাকে সেটাও সে অনায়াসে আপনার সঙ্গে শেয়ার করবে। এতে করে সন্তান বিপথে যাবে না। এক কথায় সন্তান ও বাবা মায়ের মধ্যে কোনো গ্যাপ থাকবে না।
সুপ্রতিম বড়ুয়া সাবেক অধ্যক্ষ, রামু সরকারি কলেজ, কক্সবাজার।