
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার প্রধান উপাদান চালের বাজার বেশ কয়েক মাস ধরেই অস্থির। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উচ্চমূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ উচ্চখাদ্যমূল্যস্ফীতি। বিগত জুলাই মাসে খাদ্যমূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩.৮০ শতাংশ। গত মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ৮.৯৩ শতাংশে। গেল জুনে তা আরো কমে ৭.৩৯ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। তবে চাল, আলু ও সবজির সাম্প্রতিক উচ্চমূল্যের কারণে খাদ্যমূল্যস্ফীতি আরো শিথিল হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেছে। ধানের ভরা মৌসুমে দাম কিছুটা কম ছিল। এই মৌসুম পার না হতেই যখনের কৃষকের ধানের গোলা থেকে ধান বের হয়ে গেল, তখনই আবার বাড়ছে চালের দাম। বিগত সময়ে পর্যবেক্ষনে দেখা এ সময় চালের দাম স্থিতিশীল থাকার কথা, কিন্তু চালের বাজার হাটছে উল্টো পথে। তবে বোরো ধানের মৌসুম শেষে এভাবে দাম বাড়ার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই বলে মনে করছেন। বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মতে এটাকে যেরকম অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজি ও অ্ন্যদিকে সরকারের রেগুলেটরী সংস্থাগুলোর বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ না করাটাকেই দায়ী করছেন। যার জলন্ত উদাহারণ হলো চালের মূল উৎসস্থল করপোরেট গ্রুপের গুদামে, মিলগেট ও পাইকারী বাজারে নজরদারির তেমন নাই।
বেশ কয়েকবছর ধরেই আমরা লক্ষ্য করছি, ধানকাটা শেষ না হতেই কিছু চালের বড়ব্যবসায়ীরা ধান কিনে গুদাম ভর্তি করে রাখছেন। মিলারদের মতে, একাজে করপোরেট হাউসগুলো তাদের আধিপত্য সবচেয়ে বেশি। একাজে বড় অটো রাইস মিলাররাও তাঁদের আধিপত্য ধরে রাখতে পিছ পা হচ্ছেন না। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন মাঝারি ও ক্ষুদ্র মিলমালিকরা। তাঁদের কারণেই ধান-চালের দাম এভাবে বাড়ছে। তবে ধান চালের বাজার দীর্ঘসময় ধরে তদারকির বাইরে। মিলার ও করপোরেট গ্রুপরাই নিজেরা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা দাম বাড়ায় ও কমায়। একটা সময় তারা অভিযোগ করলেন করপোরেট গ্রুপটরা ধান চাল সংরক্ষণের কারণে দাম বাড়ছে। আবার অভিযোগ করা হলো পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধিসহ ভারত থেকে চাল আমদানি হচ্ছে না এরকম অনেক খোড়াযুক্তি। তবে খাদ্যবিভাগ যারা ধান চালের বাজারের মূল চালিকাশক্তি। তারা বলে আসছেন, খাদ্যবিভাগের মূল কাজ হলো ধান চাল সংগ্রহ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার খাদ্যবিভাগ ধান সংগ্রহ করে মিলারদের মাধ্যমে। কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ করা হলে কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পেতেন। এখন কৃষকরা কমদামে ধান বিক্রিতে ন্যায্যমূল্য পান না, অন্যদিকে ভোক্তারা অধিক দামে চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, এবার দেশে চালের কোনো সংকট নেই। সরকারি পর্যায়ে চালের মজুদ আছে ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৭৭৫ টন। গমসহ মোট খাদ্যশস্য আছে ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ২৭৬ টন। এ ছাড়া ধানের মজুদ আছে দুই লাখ ২৪ হাজার ৭৪৫ টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১৩ লাখ পাঁচ হাজার টন চাল। গম আমদানি হয়েছে ৬২ লাখ ৩৫ হাজার টন। মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৫ লাখ ৪০ হাজার টন। আবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে চালের মোট সম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হচ্ছে প্রায় চার কোটি ১৯ লাখ টন। গত পাঁচ বছরের মধ্যে চালের উৎপাদন, আমদানি ও মজুদ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ছিল সর্বোচ্চ। সে তথ্য পর্যালোচনা করলে বলা যায় এবার চালের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যুক্তিসংগত কারণই নেই।
চালের ব্যবসায়ীদের মতে, তাঁরা এখন বেশি দামে ধান কিনেছেন, সেকারণে চালের দাম পড়ছে বেশি। প্রকৃত প্রস্তাবে বড় মিলাররা ধান কিনে নিয়েছেন উৎপাদনের পরপরই। অনেকে অগ্রিম দাদন দিয়ে কৃষক থেকে ধান কিনে নিয়েছেন। তখন প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছে ৯০০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকা দামে। সরকার নির্ধারিত ছিলো এক হাজার ৪৪০ টাকা এই দর কখনোই কৃষকদের দেননি ব্যবসায়ীরা। মধ্যসত্ত্বভোগী হিসাবে পুরো লাভটি তারা নিয়ে নিয়েছেন। পরে যখন মোকামে ধানের দাম বেড়েছে, তখন কৃষকদের হাতে বিক্রির মতো আর ধান নেই। ধানের মজুত সব চলে গেছে ব্যবসায়ীদের গুদামে। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে দাম বাড়ানোর চেষ্টায় মারিয়া।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এবার দেশে বোরোর উৎপাদন বেশ ভালো হয়েছে। দেশের মোট চাল উৎপাদনে বোরোর হিস্যা প্রায় ৫৪ শতাংশ। অতএব, এই মৌসুমের গুরুত্ব বেশি। চলতি মৌসুমে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দুই কোটি ২৬ লাখ টন অর্জন করা সম্ভব না হলেও গত বছরের দুই কোটি সাড়ে ১০ লাখ টনের তুলনায় অনেক বেশি হবে। কমপক্ষে দুই কোটি ১৪ লাখ টন হবেই। এটি আমাদের বার্ষিক চাহিদার অর্ধেকের চেয়েও বেশি। যা আগামী ডিসেম্বর মাসে আমন মৌসুম পর্যন্ত তাতে অনায়াসেই চলবে। অতএব, অদূর ভবিষ্যতে দেশে চালের কোনো সরবরাহ সংকট হবে না। সামনের আউশ মৌসুমের উৎপাদন ভালো হলে এবার চাল আমদানির প্রয়োজন হবে না। বর্তমানে চালের দাম বাড়ার অজুহাতে অনেকে চাল আমদানির পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে করে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়বে, এতে কোন সন্দেহ নাই। তবে আমাদের বিগত সময়ের অভিজ্ঞতায় বলছে আমদানীকৃত চালগুলো কোথায় যাচ্ছে, তার কোন তদারকি করা হয় না। গতবছর বেসরকারি আমদানিকারকদের ১৪ লাখ ৯০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত সময়ে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ চাল আমদানি করা হয়েছিল। আর যারা মিল মালিক ও করপোরেট গ্রুপ তারা আবার চাল আমদানিকারক। যার কারণে এতে লাভবান হবেন চাল আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা এবং বিদেশের চাল উৎপাদনকারী কৃষকরা। বাংলাদেশের কৃষকরা তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যদি আমদানিকৃত চালগুলি আমদানির পর সারা দেশের বাজারে যাচ্ছে কিনা? নাকি কোন এক জায়গায় মজুত হয়ে থাকছে, তা তদারকি না করলে চাল আমদানি করলেও ভোক্তারাও লাভবান হবেন বলে মনে না। তবে দীর্ঘমেয়াদী হিসাবে আউশ ও আমন ধানের নিরাপদ উৎপাদনের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা নিলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত সম্ভব হবে। বাজারের সরবরাহ ব্যবস্থায় সরকারের কোন হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান না হলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
আমরা বারংবার বলে আসছি, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বড় কারণ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। প্রকৃত উৎপাদকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পান না আর ভোক্তারা বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হন এটাই দেশীয় প্রচলিত খাদ্য পণ্যের বাজার। আবার এই মধ্যসত্ত্বভোগীদের তৎপরতা বন্ধে সরকারের উদ্যোগগুলিও অনেক সময় দৃশ্যমান হয় না এবং মাঝে মধ্যে এসমস্ত উদ্যোগগুলো মধ্যসত্ত্বভোগীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে থাকেন। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর পক্ষ থেকে বারাংবার দাবি করা হচ্ছে মধ্যসত্ত্বভোগীদের লাগাম টেনে ধরতে মিল, মজুতকারী করপোরেট গ্রুপ, পাইকারী বিক্রেতা, আমদানিকারক ও খুচরা পর্যায়ে নিয়মিত বাজার তদারকি নিশ্চিত করা দরকার। খাদ্যবিভাগ বলে থাকেন তারা শুধুমাত্র ধান চাল সংগ্রহ ও কৃষি বিভাগ শুধুমাত্র উৎপাদনের সাথে জড়িত। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যদি তদারকি নিশ্চিত না হয় তাহলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হন। বাজার তদারকি কালে দায়িত্বপ্রাপ্তদের পণ্যের যৌক্তিক মূল্য সম্পর্কে ভালো পরিস্কার ধারণা থাকা দরকার। অথবা এ পরিদর্শন কালে এখাতে অভিজ্ঞদের যুক্ত রাখা দরকার। তাহলে তারা বাজারে পণ্যমূল্য নিয়ে কারসাজি সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে। এছাড়াও বাজারে কারসাজির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ও সর্বনিন্ম পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দিলে উভয়ে লাভবান হতে পারে। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়ে বিপণন খরচ ও মুনাফা যোগ করে নির্ধারিত হবে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য। বিপণন ও বাজার ব্যবস্থায় শৃংখলা আনতে প্রতিটি স্তরে পণ্য মূল্য উন্মুক্ত থাকা দরকার। বিশেষ করে বিগত সরকারের সময় চালের বস্তায় উৎপাদনের তারিখ, শষ্যের জাত ও মূল্য লেখার বিধানটি অনুস্মরণ করা গেলে ভোক্তাকে ঠকানো, কেউ চড়া দাম হাঁকিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না।
চালের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি) ও ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব সম্প্রতি দেশব্যাপী প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন করেছেন। খানির পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবও তুলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আছে কৃষকের কাছ থেকে সরকারের সরাসরি চাল ক্রয়ের আওতা বৃদ্ধি করা, দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা, বাজার, উৎপাদন, মূল্য নির্ধারণ এবং ভোগের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার সহায়তায় টিসিবি এবং ওএমএস কর্মসূচির আওতাবৃদ্ধির মাধ্যমে প্রয়োজনভিত্তিক সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করা, মিল, করপোরেট গ্রুপসহ চালের বাজার যথাযথ মনিটরিং এবং সিন্ডিকেট এর অপতৎপরতা রোধ করার মাধ্যমে দ্রুত বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে চালের মূল্য ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে আনা অন্যতম। এ ছাড়াও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত বাজার তদারকি জোরদার, চালের বাজারের সাথে যুক্ত সকল স্তরে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। অতিমুনাফাখোর, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও সিন্ডিকেটের কারসাজি থামাতে সরকারকে যেরকম কঠোর হতে হবে তেমনি বিকল্প হিসাবে দরিদ্র প্রান্তিক মানুষদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা কার্যকর করা, খাদ্য বিভাগের খোলা বাজারে ওএমএস ও টিসিবির ট্রাক সেলে জোরদার করতে হবে। বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ আরো দৃশ্যমান ও কার্যকর করতে হবে।
এস এম নাজের হোসাইন ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।