চট্টগ্রাম সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

সুরের সঙ্গে রবি চৌধুরী’র তিন যুগ
রবি চৌধুরী

গানের টানে ঘরছাড়া ছেলেটিই ভেঙে দিয়েছিলেন অডিও গানের রেকর্ড

সুরের সঙ্গে রবি চৌধুরী’র তিন যুগ

পূর্বকোণ ডেস্ক

২২ জুলাই, ২০২৫ | ১১:৩৫ অপরাহ্ণ

রবি চৌধুরী, নব্বই দশকের বাংলা সংগীতের জনপ্রিয় মুখ। ‘প্রেম দাও’ অ্যালবামের মধ্য দিয়ে শ্রোতামনে জায়গা করে নেন তিনি। এরপর ‘এক নয়নে কান্দো’, ‘অন্তর থেকে বলছি’, ‘তুমি দুঃখ পাও’সহ একাধিক হিট এলবামে কণ্ঠ দেন। তিন যুগের সংগীত ক্যারিয়ারে ৬৪টি অডিও অ্যালবাম ও ৭০-৮০টি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেছেন। কাজ করেছেন সংগীত পরিচালক হিসেবেও। এই দীর্ঘ যাত্রায় নিজের চড়াই-উৎরাই ও বর্তমান ব্যস্ততার কথা জানালেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলেছেন রহিম সৈকত

 

রহিম সৈকত : আপনার জন্ম, বেড়ে উঠা, পড়ালেখা নিয়ে যদি আমাদের বলতেন?

রবি চৌধুরী : আমার জন্ম বাঁশখালীর পূর্ব পুইছড়ি গ্রামে। বাবা সর্দার কবির আহমেদ, মা লায়লা কবির। ছোটবেলা হতে আমার সুরের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। এত চঞ্চল ছিলাম- কোথাও বেশিক্ষণ স্থির থাকতে পারতাম না। পুইছড়ি ইজ্জতিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় গানের নেশা আমাকে পেয়ে বসে, তাই পড়ালেখার চেয়ে পাড়া-মহল্লায় বেজে উঠা মাইকের আওয়াজ আমাকে টানত। এমন হয়েছে অনেকবার এলাকায় কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে আর আমি স্পিকার নিয়ে গান শুরু করে দিয়েছি। পেছনে কখন বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করিনি। আমার গান শুনত কিছু সময় নিয়ে, একসময় বলেন, ‘রবি চল তোমার মা খুঁজছে অনেক্ষণ ধরে’। আমার হাত ধরে পরম মমতায় নিয়ে যেতেন বাড়িতে। এই নিয়ে বাবার কাছে মায়ের অভিযোগের অন্ত ছিল না। আসলে এসবে বাবার মৌনসম্মতি ছিল তাই মায়ের যত রাগ-অভিমান বাবার উপর। মা মাঝেমধ্যে বাবার অনুপস্থিতিতে খুব মারতেন, কিন্তু সেই শাসনে ছিল মমতার ছায়া। যেদিন মা আমাকে মারত সেদিন মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। মায়ের সাথে বলতাম এসব আর হবে না কিন্তু গান ততদিনে রক্তের সাথে মিলেমিশে একাকার। পালিয়ে চলে গেলাম ওস্তাদ মরহুম আহমদ কবির আজাদ’র কাছে। তিনি তখন বদরখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াতেন পাশাপাশি বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। স্যার আমাকে পুত্রের মত গ্রহণ করলেন। তার হাত ধরে আমার সংগীত জীবনের প্রথম হাতেকড়ি। তিনি আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন বদরখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে। সংগীত চর্চা আর বিদ্যাঅর্জন এক সাথে চলতে লাগল। এরপর দুই বছর ছিলাম বদরখালীতে পরে আবার চলে যাই ওস্তাদ আবু বক্কর সিদ্দিকির কাছে। তিনি কক্সবাজার সংগীতায়নের ওস্তাদ ছিলেন। পরবর্তীতে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করি।

 

সৈকত : সংগীতকে যখন পেশা হিসেবে নিলেন তখনকার কথা যদি স্মৃতিরপাতা থেকে আমাদের বলতেন?

রবি চৌধুরী : ১৯৮৫-তে চট্টগ্রামের নিউমার্কেটের ঐকতান থেকে আমার প্রথম অডিও অ্যালবাম বের হয়। ঐকতান থেকে তখনকার সময়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী শেফালি ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব, কল্যাণী ঘোষ’র মত প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর অ্যালবাম বের হত। আমার সেই অ্যালবাম-এ ছিল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান ও ভাণ্ডারী গান দিয়ে সাজানো। ‘ও বাবা মওলানা কি সুন্দর বানাইলা তোমার আস্তানা’ এই গানটি ছিল ঐ অ্যালবামের সূচনা সংগীত। ঐ গানেই চট্টগ্রামে মোটামুটি পরিচিতি পাই কিন্তু তাতে বেশি বিনিময় পাইনি। মন থেকে তখন ঢাকার টান অনুভব করতে লাগলাম।

 

সৈকত : সমগ্র বাংলাদেশ রবি চৌধুরীকে চেনা শুরু করল কখন থেকে?

রবি চৌধুরী : ঢাকার সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সেলেক্স’র ব্যানারে আমার অ্যালবাম ‘প্রেম দাও’ রিলিজ হওয়ার পর নিজের অবস্থানটি শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে পেরেছিলাম। এরপর আমাকে আর পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। আর ‘অন্তর থেকে বলছি’ পাশাপাশি এসব ছিল নিজকে ছাড়িয়ে যাওয়ার গল্প। সে সময় বিয়েবাড়িতে, পিকনিকে, মেলায়, শ্রোতার মুখে-মুখেই ছিল রবি চৌধুরী। আকাশ হারায় নীল, মনে পড়ে তোমাকে, মন পাখিরে, কতটা দুঃখ, দেখতে লাগে কালারে, কালনাগিনী, বিরহের শয্যায়, অন্তর থেকে বলছি, পৃথিবীকে চিনি, সাদা কাফনে, বৃক্ষ যেমন, নিঃস্ব করে দিওনা, দু’চোখের জল, মনে রেখ এসব গানই রবি চৌধুরীকে পৌঁছে দেয় বাংলার ঘরে ঘরে।

 

সৈকত : নব্বই দশকে রবি চৌধুরীর অ্যালবাম মানে ব্যবসা সফল। সেই শ্রোতাপ্রিয় অ্যালবামগুলোর মধ্যে আপনার নিজস্ব মূল্যায়নে কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন?

রবি চৌধুরী : গানগুলো আমার সন্তানের মত। এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে মা তার কোন সন্তানকে বেশি ভালবাসেন? মায়ের জবাব কী হবে? এটা ঠিক, কোম্পানির চাহিদার কারণে কিছু চটুল গান গেয়েছি। কোম্পানির বাণিজ্যিক দিক ঠিক রাখতে গিয়ে অনেক সময় শিল্পীকে গুণগতমানের প্রশ্নে ছাড় দিতে হয় তেমনটা আমাকেও দিতে হয়েছে।

 

সৈকত : রবি চৌধুরী হয়ে উঠার পথে চড়াই-উৎরাই কেমন ছিল?

রবি চৌধুরী : অনেকটা শূন্য পকেটে উদ্ভ্রান্তের মত ঢাকায় আসা, সেখানে গিয়ে প্রয়াত খালিদ হোসেন মিলু ভাইয়ের সহযোগিতা পাই। আমাকে ছোট ভাই বলে পরিচয় দিতেন সব জায়গায়। আমার একটা স্বর্ণের মোটা আংটি ছিল। ওটা বিক্রি করে গান রেকর্ডের টাকা যোগাড় করি। আমার লেখা ‘বেদনার সবটুকু আমাকে দিয়ে সুখ নিয়ে তুমি ফিরে যাও’। অন্যটি ‘আমি আজ জেনে গেছি তুমি আমাকে ছেড়ে আজ ফুল ভেবেছো’ এই দুইটা গান রেকর্ড করেছিলাম। গান দুটো শুনেই আমার অ্যালবামটা নিয়েছিল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। শিরোনাম দিল ‘প্রেম দাও’, দর্শকরা আমাকে এত প্রেম দিয়েছে যার জন্য আজ আমি রবি চৌধুরী।

 

সৈকত : জীবনের যে স্মৃতি আজও আপনাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়?

রবি চৌধুরী : কুরবানির ঈদের দিন বাবাকে হারিয়েছি। কুরবানির ঈদ আসলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। এই দিনটাকে কখনও ভুলতে পারি না।

 

সৈকত : সর্বশেষ ব্যস্ততা সম্পর্কে যদি বলতেন?

রবি চৌধুরী : বর্তমানে ১০০ গানের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। পাশাপাশি গজলও করছি, আমার পুরোনো জনপ্রিয় ৫০টি গান এবং নতুন ৫০টি গান নিয়ে এই প্রকল্প।

 

সৈকত : অনেক ধন্যবাদ, ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেয়ার জন্য

রবি চৌধুরী : প্রতিদিন একটি করে বন্ধু বাড়ান, শত্রু বাড়াবেন না। ভালো কাজ করুন। ভালোর সাথে থাকুন। সেই সাথে দেশসেরা আঞ্চলিক পত্রিকা দৈনিক পূর্বকোণসহ আপনাকেও ধন্যবাদ।

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট