চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

ডেঙ্গিকে নিয়েই থাকতে হবে, জানতে হবে
ফাইল ছবি

ডেঙ্গিকে নিয়েই থাকতে হবে, জানতে হবে

অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস

২০ জুলাই, ২০২৫ | ১২:০৮ অপরাহ্ণ

বছরের এই সময়ে ডেঙ্গি নিয়ে খুব শোরগোল হয় রোগ সংক্রমণের প্রাদুর্ভাবের জন্য। সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় হাসপাতালে রোগী ভর্তির আর মৃত্যুর সংখ্যা, ডেঙ্গি নিয়ে শঙ্কা, সমালোচনা ও ফোড়ন। দোষারোপ আর প্রতিদোষারোপের দ্বন্দ্ব। প্রতিরোধ আর নির্মূলের সোনার হরিণের পেছনে দৌঁড়। জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী ও আতঙ্ক ঘনীভূত। আবেগ আর স্বীয় বদ্ধমূল ধারণার ঘূর্ণিতে সব আবর্তিত হতে থাকে। বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ব উপেক্ষিত হয়। সমস্যা সেই সমস্যার তিমিরেই রয়ে যায়। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়- ডেঙ্গিকে কখনো পুরোপুরি নির্মূল বা প্রতিরোধ করা যাবে না। তাই যা করতে হবে তা হলো- ‘ডেঙ্গিকে নিয়ে সক্ষম হয়ে টিকে থাকতে হবে’।

 

১। যে সংক্রামক রোগের টিকা নেই, সে সব রোগ নির্মূল করা যায় না। ডেঙ্গি ভাইরাসের চারটি প্রজাতি আছে। এই ভাইরাসের কোনো জটিল জীবনচক্র নেই এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল জিনবিন্যাসের জন্য কার্যকর প্রতিরোধী এন্টিবডি তৈরি করে টিকা বানানো যাচ্ছে না। ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার কোনো এন্টিবায়োটিকও নেই।

 

২। এডিস মশা হলো ডেঙ্গি ভাইরাসের বাহক। এ মশা ঘরের ভেতরে থাকে, সকাল ও বিকেলে মানুষকে কামড়ায়, একটি মশা অনেকজনকে কামড়াতে পারে। মশা থেকে তার ডিমের মধ্যে ভাইরাস গিয়ে সুপ্ত থাকতে পারে। মশা সাধারণত কৃত্রিম ধারকে স্থির পরিষ্কার পানির পৃষ্ঠতলের সামান্য ওপরে ডিম পাড়ে। এই ডিম পানি শুকিয়ে গেলেও বছর বছর বেঁচে থাকে। মৌসুমের শুরু আর শেষ দিকের বৃষ্টির ধারা নামলে ডিম ফুটে। প্রবল বৃষ্টিপাতে ডিম ফুটে লার্ভা তৈরি হলেও, অতিরিক্ত পানির প্রবাহে অনেক লার্ভা ভেসে যায়। তখন প্রকোপ কমে বাহকের অভাবে।

 

৩। ডেঙ্গির ইমিউনিটি বা সংক্রমণ-জনিত প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা বিচিত্র। সাধারণত একবার সংক্রমণ হলে সেই প্রজাতির বিরুদ্ধে আজীবনের জন্য ইমিউনিটি তৈরি হয়। একইসাথে অন্যান্য প্রজাতির বিরুদ্ধেও প্রায় এক বছরের মতো একটি অস্থায়ী সুরক্ষা তৈরি হয়। তাই এক বছর বেশি হলে পরের বছর কম হয়।

 

৪। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো, এক প্রজাতির ভাইরাসে সংক্রমণের পর যদি অন্য প্রজাতির দ্বারা সংক্রমণ হয়, তখন ডেঙ্গি রক্তক্ষরণ জ্বর হতে পারে। শুরুতে সাধারণ ডেঙ্গি জ্বর ও রক্তক্ষরণ ডেঙ্গির পার্থক্য বোঝা যায় না। মনে রাখতে হবে, সাধারণ ডেঙ্গি জ্বর কখনো রক্তক্ষরণ ডেঙ্গিতে রূপান্তরিত হয় না।

 

৫। ডেঙ্গি সাধারণত সুঠামদেহী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষদের হয়। অপুষ্টিতে ভোগা মানুষদের হয় না। তাই এটি সচ্ছল শ্রেণির মানুষের রোগ হিসেবে বেশি দেখা যায়, যার জন্যই শোরগোলও বেশি।

 

৬। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডেঙ্গি লক্ষণবিহীনভাবে হয়। এটি একটি স্বনিয়ন্ত্রিত রোগ। মানে- নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। ভাইরাস নিজে নির্মূল হয়। রোগের দিনগুলোতে কেবল উপসর্গ অনুযায়ী সহায়ক চিকিৎসা দিতে হয়। সময়মতো শনাক্ত ও দ্রæত ব্যবস্থা না নিলে জটিলতা তৈরি হয়ে মৃত্যু হতে পারে। ডেঙ্গি প্রতিরোধ বা নির্মূল করা সম্ভব নয় বিধায় চৌকস, টেকসই শনাক্তকরণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রয়োজন। মূল লক্ষ্য দুটি। ১. মৃত্যু ঠেকানো, ২. রোগভোগের কষ্ট কমানো।

 

ডেঙ্গি রক্তক্ষরণ জ্বরের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। কারা ঝুঁকিতে আছেন, তা জানতে হবে। যাঁদের পূর্বে অন্য প্রজাতির ডেঙ্গি হয়েছে, তাঁরা বেশি ঝুঁকিতে। দ্রুত শনাক্তকরণ ও ত্বরিত চিকিৎসা সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। এই জায়গাতেই রয়েছে আমাদের বড় প্রতিবন্ধকতা। আবার ভুল ধারণার ফাঁদে পড়ে সবাই নিজ নিজ মতো কাজ করছে। যেমন: নির্বিচারে কিটনাশক স্প্রে বা ফগিং, যেখানে-সেখানে লার্ভা খোঁজা আর হইচই। প্রতিদিন কত রোগী ভর্তি হলো, কতজন মারা গেল- এই সবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভাইরাসের প্রজাতি, ঘনত্ব ও ব্যাপকতা জানা। ডেঙ্গি প্রাদুর্ভাব কমিয়ে রোগীর সংখ্যা কমানো ও মৃত্যুহার কমানোর জন্য একটি বিস্তৃত ‘হোমওয়ার্ক’ করতে হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায় ও জাতীয়ভাবে। সবাইকে জানতে হবে কার কী দায়িত্ব।

 

সবার জানা থাকতে হবে: ডেঙ্গি কীভাবে হয়, কখন হয়, কীভাবে ছড়ায়, কীভাবে সন্দেহ বা শনাক্ত করা যায়, পূর্বে আক্রান্ত হয়েছি কিনা। মশার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। মশার উৎস বন্ধ করতে হবে। শুরুটা হতে পারে- ফ্রিজের নিচের ট্রে, ফুলদানি বা টবের নিচে পানি জমতে না দেওয়া থেকে। তথ্য প্রবাহ ও সংরক্ষণ জরুরি। সাধারণ ডেঙ্গি জ্বরের তথ্য ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাইরাসের প্রজাতির তথ্য সংরক্ষণ প্রয়োজন। একাধিক প্রজাতি থাকলে তা ডেঙ্গি রক্তক্ষরণ রোগের সম্ভাবনার পূর্বাভাস দেয়।

 

ডেঙ্গির বিচিত্র ইমিউন প্রতিক্রিয়ার জন্য সাধারণত এক বছর পর পর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। আমাদের দেশে জোড় সংখ্যাবর্ষে ডেঙ্গির প্রকোপ বেশি দেখা যায়। প্রথম প্রাদুর্ভাব হয়েছিল ২০০০ সালে। এখনো পর্যন্ত জাতীয় ডেঙ্গি রেজিস্ট্রির অভাব রয়েছে- যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ অবহেলিত। মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- অঞ্চলভিত্তিক তথ্য। যা মানুষকে আগেভাগে সতর্ক করবে। একইসঙ্গে জানতে হবে কার কী দায়িত্ব- ব্যক্তি, পরিবার, চিকিৎসক, হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট সবাই। জাতীয় গাইডলাইনে সবই আছে। সবার আচরণে থাকা উচিত স্বপ্রণোদিত অংশগ্রহণ। ডেঙ্গিকে ঠেকাতে এটা সবচেয়ে জরুরি।

 

এডিস মশার ডিম সাধারণত শুকনা অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকে এবং সেগুলোর মধ্যেই ভাইরাস সক্রিয় অবস্থায় থাকে। ডিম ফুটে মশা হয়ে গেলে সেটি আগে থেকেই সংক্রমিত থাকে এবং মানুষকে কামড়ালে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ডেঙ্গি ভাইরাস মশার দেহে কোনো পরিবর্তন বা অভিযোজন ঘটায় না। এই শুকিয়ে থাকা ডিমগুলো নির্মূল করা বাস্তবভাবে অসম্ভব। ফলে ডেঙ্গিকে পুরোপুরি নির্মূল করা যাবে না।

 

জনস্বাস্থ্যের সংক্রামক রোগ বিশ্লেষণের জন্য আছে ‘থ্রি পি’ ধারণা। ১. Population (জনগোষ্ঠী) ২. Period (সময়কাল) ৩. Problem (সমস্যা)। ডেঙ্গির সময়কালে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জ্বর বা রক্তক্ষরণজনিত উপসর্গ দেখা দিলে আগে সন্দেহ করতে হবে। যখন নির্মূল করা যাবে না, টিকা দেওয়া যাবে না, ওষুধে ভাইরাস ধ্বংস করা যাবে না- তখন ডেঙ্গিকে নিয়েই থাকতে জানতে হবে। আর তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে- ‘ক্ষমতায়ন’।

 

 

এই অস্ত্রের সূত্র: ডেঙ্গিকে জানা ও বোঝা, ভাইরাসের প্রজাতি সম্পর্কে তথ্য, পূর্ব সংক্রমণের স্মরণ, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ, মশার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা, সক্রিয় সামাজিক আন্দোলন। এটাই হলো- ডেঙ্গিকে নিয়েই টিকে থাকা। তাতেই ডেঙ্গিকে বশ করা যাবে।

 

লেখক : ডেঙ্গি শনাক্তকারী পথিকৃত গবেষক ও জাতীয় চিকিৎসা গাইডলাইনের প্রথম সম্পাদক

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট