
চট্টগ্রামে ফের ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। নগরীর তুলনায় গ্রামাঞ্চলেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। অথচ সেসব এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণ, পরিচ্ছন্নতা কিংবা জনসচেতনতা কার্যক্রম প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে দিনে দিনে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এমনিতে উপজেলাগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা সীমিত। এর মধ্যে মশকনিধন বা ওষুধ ছিটানোর কার্যকর উদ্যোগও চোখে পড়ছে না।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৫৬৩ জন। এর মধ্যে ৩০৯ জন জেলার ১৫টি উপজেলার এবং ২৫৪ জন নগরীর বাসিন্দা। অর্থাৎ, আক্রান্তের ৫৫ শতাংশই হচ্ছে উপজেলা পর্যায়ের।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, জানুয়ারি মাসে ৭০ জন আক্রান্ত হন, যার মধ্যে ২৭ জন নগরীতে এবং ৪৩ জন উপজেলার বাসিন্দা। ফেব্রæয়ারিতে ২৮ জন আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ১৩ জন নগর এবং ১৫ জন উপজেলা এলাকার। মার্চে ২২ জনের মধ্যে ১২ জন নগরীর এবং ১০ জন উপজেলার। এপ্রিলে ৩৩ জন আক্রান্তের মধ্যে ১৯ জন নগর এবং ১৪ জন উপজেলার। মে মাসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬ জন, যার মধ্যে ৬০ জনই উপজেলার। জুন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেড়ে ১৭৬ জনে পৌঁছে, এর মধ্যে ১০৮ জন উপজেলা এবং ৬৮ জন নগরীর বাসিন্দা। চলতি জুলাই মাসের প্রথম ১১ দিনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১১৮ জন, যার মধ্যে ৫৯ জন নগর এবং ৫৯ জন উপজেলার।
উপজেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বাঁশখালীতে। এ উপজেলায় আক্রান্ত হন ৯৪ জন। এরপর রয়েছে সীতাকুণ্ডে ৭১ জন, আনোয়ারায় ২৫ জন, সাতকানিয়ায় ২৪ জন, লোহাগাড়ায় ২১ জন, রাউজানে ১৩ জন, পটিয়ায় ১০ জন। এছাড়া মিরসরাই ও হাটহাজারীতে আটজন করে, চন্দনাইশ, রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুণ্ডে সাতজন করে, কর্ণফুলীতে ছয়জন এবং সন্দ্বীপে তিনজন আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ৩১৮ জন পুরুষ, ১৫৬ জন নারী এবং ৮৯ জন শিশু।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন আর কেবল নগরের রোগ নয়। গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ মশকনিধন কার্যক্রমের অভাব এবং জনসচেতনতার ঘাটতি। তাই এখনই প্রতিটি ইউনিয়ন, গ্রাম ও উপজেলা এলাকায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম চালানো না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। শুধু হাসপাতালভিত্তিক চিকিৎসা দিয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। বরং মশকনিধন এবং জনসচেতনতা কার্যক্রমে জোর দিতে হবে।
যদিও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, নগরীর বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম একেবারেই দুর্বল। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনপ্রতিনিধি না থাকায় সমন্বয়হীনতারও সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, চিকিৎসকদের আশঙ্কা, গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে যে বৃষ্টি হচ্ছে, এতে ডেঙ্গুর বিস্তার আরও বাড়তে পারে।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, উপজেলাগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হওয়ায় আগে থেকেই সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মশকনিধন কার্যক্রম চালানোর কথা বলা হয়েছে। জনগণকেও এ নিয়ে সচেতন হতে হবে। দুটি উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, আমরা কেবল আক্রান্ত রোগী পেলেই হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করছি। কিন্তু উৎসস্থলে ডেঙ্গু নির্মূলের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ফলে পরিস্থিতি দিনে দিনে জটিল হচ্ছে।
খবর নিয়ে জানা গেছে, নগরীতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নিয়মিত মশকনিধন কার্যক্রম ও জনসচেতনতা প্রচার চালালেও গ্রামাঞ্চলে এই কার্যক্রম নেই। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসন মাঝে মাঝে সভা করে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় বসে, কিন্তু গ্রামের ডোবা-নালা, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হয় না। বর্ষার মৌসুমে এসব জায়গায় পানি জমে থেকে এডিস মশার প্রজনন কেন্দ্র হয়ে উঠছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবদুর রব বলেন, এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা ছাড়া ডেঙ্গু ঠেকানো যাবে না। এখন উপজেলা পর্যায়ে জরুরিভিত্তিতে অভিযান চালানো দরকার। তা না হলে সামনে আরও ভয়ংকর হবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই প্রয়োজন প্রতিটি ইউনিয়ন, গ্রাম ও উপজেলার স্কুল-কলেজ, বাজার এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম শুরু করা। নাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে বেশি সময় লাগবে না। পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
পূর্বকোণ/ইবনুর