
‘মাছ-ভাতে বাঙালি’ বলা হলেও সাধারণ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার মূল চালের বাজার প্রতিনিয়তই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর চাল আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার প্রধান উপাদান। এমনিতেই নিত্যপণ্যের বাজারের অস্থিরতা কোনভাবেই কাটছেই না। সবজিসহ অন্যান্য পন্যের দাম বাড়লে সে পণ্য ক্রয়ে কৃচ্ছ্রতা সাধন করা গেলেও চালের বেলায় তো সেটা হয় না। কারণ চাল আমাদের প্রতিদিনের প্রধান খাদ্য। দাম বাড়লেও মানুষকে চাল কিনতেই বাধ্য। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অসহায়ত্ব।
সীমিত আয়ের মানুষের জন্য এই বাড়তি চাপ মেটানো দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। সেখানে চালের বাজারে প্রতিনিয়তই দামবৃদ্ধি সাধারণ ক্রেতার কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ। যারা বাজারে যান, তারা বলতে পারেন প্রতি সপ্তাহে চালের দাম ১-৫ টাকা কোন কারণ ছাড়াই বাড়ছে। আর এই বিষয়টি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। যদিও চালের ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করলে বলেন, মিল-মালিকরা করপোরেট গ্রুপরা ওপর দোষ চাপান আর করপোরেট গ্রæপরা মিল-মালিকদের ওপর দোষ চাপিয়ে উভয়ে মানুষের পকেট কাটছে। উভয়ে একে অপরকে দোষারূপ করে সপ্তাহের ব্যবধানে সারা দেশসহ রাজধানীর বাজারে সবধরনের চালের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ দাম বৃদ্ধির কারণে কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, চালের বাজার এভাবে প্রতিনিয়তই দাম বৃদ্ধি খুবই অস্বাভাবিক এবং অযৌক্তিক। ক্রেতাদের মতে, একদিকে আয়ের চাপ, অন্যদিকে প্রতিদিনের নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। হঠাৎ করে এভাবে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ভোক্তাদের কষ্ট আরও বাড়বে।
বাজারে বিক্রেতাদের মতে, সরুচালের দাম হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় সবধরণের মোটাচালের দামও কিছুটা বেড়েছে। সীমিত ও প্রান্তিক আয়ের সাধারণ মানুষ যেখানে উচ্চমূল্যস্ফীতির চাপে যেখানে দৈনন্দিন নিত্যপণ্যের বাজারের হিসাব মেলাতেই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আবার হঠাৎ কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে মহাবিপাকে পড়তে হয় তাদেরকে। আগেই বলেছি, ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ায় মিল-মালিকদের দোষারোপ করছেন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা। ব্যবসায়ীনেতাদের কেউ কেউ আত্মপক্ষ সমর্থনে সাফাই গাইতে গিয়ে ধানের মূল্যবৃদ্ধি এবং সাম্প্রতিক বৈরী আবহাওয়ার দোহাই দিয়েছেন। অনেকের মতে, দেশের ধান উৎপাদনস্থল থেকে ধান সংগ্রহের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মিলাররা বেশি দামে চাল ছাড়ছেন। এছাড়াও ভোক্তাপর্যায়ে ধাপে ধাপে নানা হাত ঘুরে দাম বাড়ছে। নতুন মৌসুমে চালের সরবরাহ স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত বাজারে এ অস্থিরতা অব্যাহত থাকতে পারে।
চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বাংলাদেশ খাদ্যনিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি) ও ভোক্তা-অধিকার সংগঠন ক্যাব দেশব্যাপী প্রতিবাসভা ও মানববন্ধন করেছেন। খানির পক্ষ থেকে বেশকয়েকটি প্রস্তাবও তুলা হয়েছে। খানিসূত্রে আরও জানানো হয়, জাতিসংঘ খাদ্য সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং প্রতি ১০ জনে ৩ জন প্রয়োজনীয় খাদ্য সংস্থান করতে পারছেন না। মূল্যস্ফীতির সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের আয় না বাড়ায় ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ২০২৪ সালের শেষসপ্তাহে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসাব অনুযায়ী, এখন প্রতি মাসে ন্যূনতম খাদ্যশক্তিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে একজন মানুষের ব্যয় হচ্ছে ৩ হাজার ৫১ টাকা, যা খাদ্য দারিদ্র্যসীমার চেয়ে ৬৯.৫ শতাংশ বেশি।
খানি চালের মূল্য ও সার্বিক মুল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে সংকটপূর্ণ অবস্থা নিরসনে যে সমস্ত দাবি তোলা হয়। সেগুলোর মধ্যে আছে কৃষকের কাছ থেকে সরকারের সরাসরি চাল ক্রয়ের আওতা বৃদ্ধি করা, দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা, বাজার, উৎপাদন, মূল্য নির্ধারণ এবং ভোগের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্ষুদ্রকৃষকের স্বার্থ রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তার সহায়তায় টিসিবি এবং ওএমএস কর্মসূচির আওতাবৃদ্ধির মাধ্যমে প্রয়োজনভিত্তিক সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করা, মিল, করপোরেট গ্রুপসহ চালের বাজার যথাযথ মনিটরিং এবং সিন্ডিকেট এর অপতৎপরতা রোধ করার মাধ্যমে দ্রæত বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে চালের মূল্য ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে আনা অন্যতম।
অনেক ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে দেশে নির্বাচিত সরকার না থাকায় সরকারের মজুত নীতিমালার তোয়াক্কা করছেন না অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। এবার বোরো মৌসুমের শুরুতেই করপোরেট ব্যবসায়ীরা অগ্রিম দাদন দিয়ে হাট–বাজারে আসা অর্ধেকের বেশি ধান কিনে মজুত করে রেখেছেন। ফলে কৃষকের ধান সাধারণ মিলারদের হাতে একেবারে নেই বললেই চলে। এখন আমনের ভরা মৌসুম। আমদানিও হচ্ছে চাল। এর ফলে বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, তারপরও মিলার ও করপোরেটদের কারসাজিতে চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে সরু চাল কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা; মোটা চাল বেড়েছে ৫-৭ টাকা। অনেক মিল মালিক আবার বলছেন, আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় এখন বাজারে ধানের আমদানি কমেছে, তাই মিলে চাল উৎপাদন কম হচ্ছে। হাটে সরবরাহ কমে যাওয়ায় ধানের দামও বাড়ছে। তাই চালের দাম এখন বাড়ছে।
সাধারণ ভোক্তারা ভরামৌসুমেও চাল কিনতে বিড়ম্বনার শিকার হওয়ার বিষয়টি মানতে চান না। বাজারে ও চালের মোকামে মুজত ও সরবরাহে ঘাটতি নাই, তারপরও চালের বাজার অস্থির। ঠিক একই ধরণের অবস্থা বিগত বছেরেও আমনের বাম্পার ফলনের পাশাপাশি সরকারি গুদামে চালের মজুত পর্যাপ্ত ছিল; বাজারেও পর্যাপ্ত সরবরাহও ছিল। কিন্তু তারপরও ভরা মৌসুমে তখন চালের বাজার অস্থির ছিল। তখন কারসাজি করে চালের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে বলে বলা হতো। তখন তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরাই এই কারসাজি করে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, এখন কারা এই কারসাজি করছে? বাজার ও ভোক্তা বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন, চালের বাজারে যে অস্থিরতা সৃষ্টির নেপথ্যে সিন্ডিকেট সক্রিয় আছে। কিন্তু সরকার তাদের সেই, দাবির পক্ষে সায় দেন নি। অধিকন্তু সরকার চালের দাম কমাতে নিজেরা আমদানি করা, বেসরকারীভাবে আমদানিতে শুল্ক কমানোসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাজারে এর প্রভাব ফেলতে পারে নি। এর মূল কারণ ছিলো মুজতদার ও সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা। কাজেই যারা চালের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে, না হলে সিন্ডিকেটের সদস্যরা অন্যান্য রুটিন আকারে নিত্যপণ্যের বাজারেও অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
আমরা সকলেই জানি, গতবছর বেসরকারি আমদানিকারকদের ১৪ লাখ ৯০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হলেও কাক্সিক্ষত সময়ে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ চাল আমদানি করা হয়েছিল। আর যারা মিল মালিক ও করপোরেট গ্রæপ তারা আবার চাল আমদানিকারক। আর এসব তথ্য বিবেচনায় নিলেই স্পষ্ট হয়, বিভিন্ন গোষ্ঠী নানা কৌশলে চালসহ নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে। অতিরিক্ত মুনাফা লাভ যাদের অভ্যাস, তাদের ওপর ভরসা করা যায় না। তারা নানা ফাঁদ পেতে তাদের অভিষ্ঠ লক্ষ্য হাসিলে তৎপর থাকে। অন্যদিকে সিন্ডিকেট ও মজুতবিরোধী অভিযান জোরদার করা হলে সংশ্লিষ্ট পণ্যটির সরবরাহে আরও সংকট তৈরী করা হয়। এ থেকেই বুঝা যায় সিন্ডিকেটের শেকড় কত গভীরে গিয়ে পৌঁছেছে। কাজেই সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা রোধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। নিত্যপণ্যের দাম চড়া থাকলে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে খাওয়া কমিয়ে দেয়াসহ নানা সংকটে পড়বে। যার চুড়ান্ত পরিনতি হবে পুষ্ঠিহীনতা আর এর কারণে মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাসসহ জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই যেভাবেই হোক, চালের বাজারের অস্থিরতা দূর করতে সরকারকে কঠোর হতে হবে।
কিন্তু ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ভরামৌসুমে দাম বাড়ার কোন যুক্তিকতা নেই। তাদের মতে দেশের চালের বাজার দীর্ঘদিন ধরেই অধরা। চালের মিল-মালিক, করপোরেট গ্রুপ, পাইকারী ও খুচরাব্যবসায়ীরা তাদের মতো করেই দাম বাড়ান ও কমায়। আর এগুলো দেখার দায়িত্ব যাদের সেই খাদ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্যবিভাগ ও দপ্তরের দায়িত্বরত কর্তাদের নিরবতার কারণে ব্যবসায়ীরা তাদের মতো করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। বাজারে অন্যান্য নিত্যপন্যের নিয়মিত তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ থাকলেও খাদ্য বিভাগে অদৃশ্য কারণে নিরব থাকায় চালের বাজার তদারকি হয় না আর তদারকির অভাবেই এমনটা হচ্ছে। আমাদের কারও অজানা নয় যে, সময় ও সুযোগ বুঝে আমাদের অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কলকাঠি নাড়ে ও সক্রিয় হয়ে উঠে। মজুতদার ও সিন্ডিকেট চক্র ভাঙ্গার দাবি বারংবার করা হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ চক্রের কথা স্বীকার করতে চান না। আর সে অপচক্র ভাঙতে না পারার দায় নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা ও খাদ্য উপদেষ্টা বরাবরের মতেই সম্প্রতি আশ্বস্ত করে বলেছেন, চালের দাম সহনীয় মাত্রায় আছে এবং শিগগিরই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। কিন্তু ‘শুকনো কথায় কি চিড়ে ভিজবে?’ সরকার বাজার তদারকি জোরদার করা, দরিদ্র প্রান্তিক মানুষদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা কার্যকর করা, বিকল্প হিসাবে খাদ্যবিভাগের খোলা বাজারে ওএমএস ও টিসিবির ট্রাক সেলে যদি চাল বিক্রি না বাড়ান তাহলে চালের বাজারে অসাধু কারবারী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো যাবে। তবে হাত পা বন্ধ রেখে নিরব থেকে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
পূর্বকোণ/ইবনুর