
এক মাস আগে সহস্র ধারার জলধারায় হারিয়ে গিয়েছিল এক সম্ভাবনাময় কিশোর মো. তাসিন আনোয়ার। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি সে। বাড়ি ফিরেছিল তার নিথর দেহ, আর ফিরেছিল এক পরিবারের ভেঙে পড়া পৃথিবী। সময় যেন এক নিঃশব্দ ঋণ শোধ করতে ফিরে এলো এবার। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে এসএসসি পরীক্ষার ফল। আর সেখানেই মৃত্যুর পরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাসিনের নাম। ফলাফল? গর্বের, বেদনাভেজা এক অর্জন, জিপিএ-৫। মৃত্যুর দুয়ার ছুঁয়ে এসে তাসিন যেন সবাইকে শুনিয়ে গেল জাতীয় কবির সেই অমর বাণী আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।’
ছয় বন্ধুকে নিয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সহস্র ধারা ঝরনায় বেড়াতে গিয়েছিল তাসিন। কৈশোর মনের উচ্ছলতা তিন বন্ধুকে নামালো ঝরনার সামনে জমে থাকা পানিতে। সেটা ছিল গভীর। ফলে দু’জন উঠে গেলেও তাসিন উঠতে পারেনি। সে যখন ডুবে যাচ্ছিল তখন উদ্ধারের জন্য চিৎকার করেছিল। কিন্তু তার সহপাঠীরা মনে করেছিল, সে দুষ্টুমির ছলে চিৎকার করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তাসিন নিশ্চল হয়ে হারিয়ে যায় স্রোতের গহ্বরে। পরে তার মরদেহ পাওয়া যায়। দিনটি ছিল ১৪ জুন।
তাসিন ছিল জীবন বীমা করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (উপসচিব) লুৎফুন নাহার ও প্রকৌশলী মো. আনোয়ার কবিরের সন্তান। একমাত্র ছেলেকে হারানোর পর থেকে আর মুখে হাসি নেই এই দম্পত্তির। শোক কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তারা। কিছুটা প্রশমিত হওয়া সেই শোক ফের নতুন করে ফিরে এলো। ফল প্রকাশের দিন তাই বায়েজিদের ডিওএইচএস আবাসিক এলাকার তাসিনের ঘরজুড়ে ছিল শুধুই হাহাকার। শোকাস্তব্দ ঘরটি থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছিল কান্নার আওয়াজ। ফল প্রকাশ হতেই বাবা ছেলের ফলের নম্বরফর্দটা নিয়ে হিসেব করেছেন কত নম্বর পেলো, পাশে শোকাতুর মা কাঁদলেন নিঃশব্দে।
এরপর ছেলেকে ঘিরে আবেগঘন কথা লিখেছেন প্রকৌশলী মো. আনোয়ার কবির। বাবার সেই নাতিদীর্ঘ লেখায় উঠে আসলো তাসিনের ১৭ বছরের জীবনের নানা বাঁক। তিনি লেখেন, ‘মেধা, মননে, ধর্ম পালনে সবদিক দিয়ে এগিয়ে ছিল আমার ছেলে। স্বল্পভাষী, অতি নম্র ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য এলাকার সব বয়সের মানুষের কাছেও খুব জনপ্রিয় ছিল। কখনো কেউ যখন আমাকে সু-সন্তানের পিতা বলতো, তখন গর্বে বুকটা ভরে যেত। স্রষ্টার কাছে নীরবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতাম। আমার সেই ভালো ছেলেটা আজ কোথাও নেই।’
সন্তানহারা বাবা সেই লেখা শেষ করেন এভাবে, ‘তাসিন তোর অনেক গুণ ছিল। তোর ব্যবহারের জন্য তোকে সবাই পছন্দ করতো। আমার এই জীবনে একটা কিশোরের জন্য এত মানুষকে কাঁন্না করতে ও আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে দেখি নাই। ওপারে ভালো থাকিস বাবা!’
তাসিনের ভালো ফলের দিন মা লুৎফুন নাহারের দিন কেটেছে জায়নামাজে, আল্লাহর কাছে ছেলের জন্য প্রার্থনা করে। ছেলেকে নিয়ে বলতে গিয়ে শুধু বললেন, ‘আজ আমার ঘর থাকতো আনন্দে ভরা। আজ সেখানে নেই কোনো হাসি চারপাশে শোকের মনস্তাপ। আমার ছেলেটা দিনরাত পড়ে পরীক্ষা দিলো। আজ সে ফলটা ও দেখে যেতে পারলো না।’
তাসিন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। বলতে গেলে এই কলেজের আলো-হাওয়ায় তার বেড়ে ওঠা। নার্সারি থেকে এসএসসি-এখানেই কেটেছে তার জীবনের পুরোটা সময়। তাই তো তাসিনের এমন ফলে অশ্রু জমেছে শিক্ষকদের চোখের কোণেও। তার কথা বলতে গিয়ে বারবার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ কর্নেল মুজিবুল হক সিকদার, ‘সত্যি বলতে আমরা একটা বাচ্চাকে ঘিরে যে স¦প্নটা দেখি-ছেলেটা বড় হবে, হবে আদর্শ নাগরিক; তাসিন ছিল সে রকম। ও শিক্ষার্থী হিসেবে ছিল মেধাবী, খেলাধুলায়ও ছিল এগিয়ে। নামাজ পড়তো পাঁচ ওয়াক্ত। সবদিক দিয়ে অলরাউন্ডার। আমাদের চোখের সামনেই সে বড় হয়েছে। এমন একটা ছেলে আজ নেই। ওর ফলটা দেখে মনটা আরও একবার খারাপ হয়ে গেলো। সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া তাসিন সবমিলিয়ে ১২০৮ নম্বর পেয়েছে। এই সময়ে কেউ খারাপ ফল করলে কান্নাকাটি করে। আর ও ভালো ফল করলো সেটাই আমাদের জন্য, ওর পরিবারের জন্য কান্নার কারণ হয়ে গেলো।’
পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টফুলে বৃত্তি পাওয়া ছেলেটা পড়ালেখার পাশাপাশি প্রোগ্রামিংয়েও ছিল পাকা। গনিত ও বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশ নিতো নিয়মিত। উপস্থিত বক্তৃতায় ছিল সেরাদের একজন। খেলাধুলা থেকে সংস্কৃতিÑসবখানেই ছড়িয়ে ছিল তার পদচিহ্ন। স্বপ্ন দেখতো বড় হয়ে হবে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। প্রযুক্তিতে দেশের জন্য বয়ে আনবো দারুণ কিছু। সে স্বপ্ন আজও আছে। তবে সেটি আর তাসিনের চোখে নয়, বাবা-মায়ের শূন্য বুকের ভেতরÑএকটা গভীর ক্ষত হয়ে!