চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

মন্তব্য প্রতিবেদন

আমেরিকার নতুন শুল্কের ছোবল: বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের জন্য অশনিসংকেত

ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, সম্পাদক

৮ জুলাই, ২০২৫ | ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ

হোয়াইট হাউস থেকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন জানিয়েছে, আগামী ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের সকল রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫% হারে নতুন শুল্ক আরোপ করা হবে। এই ঘোষণাটি বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি বাণিজ্যিক বাধা নয়, বরং এটি আমাদের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির ওপর এক গুরুতর আঘাত।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি বাজার। প্রতিবছর ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাকপণ্য আমরা আমেরিকায় রপ্তানি করি। বর্তমানে যেখানে বাংলাদেশের পোশাকপণ্যের গড় শুল্কহার ১৬.৫%, সেখানে অতিরিক্ত ৩৫% যুক্ত হওয়ায় কার্যকর শুল্কহার দাঁড়াবে ৫০%-এর কাছাকাছি। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা একধাক্কায় কমে যাবে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বহু বছর ধরে চলমান এবং একপাক্ষিক। সেই ঘাটতি কাটাতে এ শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখনো একটি উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতি। আমরা অবকাঠামো, দক্ষতা ও উৎপাদন প্রযুক্তির দিক দিয়ে ভিয়েতনাম, চীন বা ভারত থেকে পিছিয়ে। ফলে আমাদের পক্ষে অতিরিক্ত শুল্কের বোঝা বহন করা কঠিন।

প্রতিযোগীদের সুবিধা, আমাদের বঞ্চনা
ভিয়েতনাম ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে EVFTA নামক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সুবিধা পাচ্ছে। পাকিস্তান GSP+ সুবিধা ভোগ করছে। ভারতও ইউরোপের সঙ্গে এফটিএ আলোচনায় এগিয়ে আছে। অথচ বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক রেয়াত পায় না। বরং বরাবরই আমরা অনুদার নীতি ও দ্বিমুখী আচরণের শিকার।
২০২৬ সালে এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে। এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘Everything But Arms (EBA)’ সুবিধাও হারাতে বসেছি। ইউরোপে যখন রেয়াত হারাচ্ছি, ঠিক তখনই আমেরিকার অতিরিক্ত শুল্ক আমাদের জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে।

কী করা উচিত?
১. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ে কূটনৈতিক আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে এই শুল্ক প্রত্যাহার বা কমানো যায়।
২. GSP সুবিধা পুনর্বহালের দাবিকে রাষ্ট্রীয় কূটনীতির অগ্রাধিকার হিসেবে নিতে হবে।
৩. রপ্তানির বহুমুখীকরণ ও বৈচিত্র্য আনতে হবে—শুধু গার্মেন্টসনির্ভরতা থেকে সরে আসা এখন জরুরি।
৪. যুক্তরাষ্ট্রে যৌথ উদ্যোগে কারখানা স্থাপন বা প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার বিষয়ে নীতিনির্ধারক মহলের চিন্তা করা উচিত।
৫. ইইউ’র GSP+ মানদণ্ড পূরণে শ্রম অধিকার, সুশাসন ও টেকসই উন্নয়নের প্রতি আরও জোর দিতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। একদিকে বৈশ্বিক মন্দা, অন্যদিকে জ্বালানি সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপ। এই নতুন শুল্ক যদি কার্যকর হয়, তবে সেটি শ্রমনির্ভর গার্মেন্টস শিল্প, রপ্তানি আয় ও লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

এই মুহূর্তে দরকার, রাজনৈতিক অভিন্ন অবস্থান, দূরদর্শী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতির সমন্বয়। নইলে, বিশ্বে ‘ডেভেলপমেন্ট মডেল’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের অর্থনীতি এক গভীর সংকটে পড়বে—যার দায় আমাদের সবাইকে নিতে হবে।

শেয়ার করুন