
খেলাধুলায় মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে রোবট- সায়েন্স ফিকশনে এমন চিত্র হরহামেশাই দেখা যায়। ১৯ এপ্রিল চীনে বেইজিংয়ে আয়োজিত হাফ ম্যারাথন দৌড়ে এই প্রথম বাস্তবেই মানুষের পাশাপাশি অংশ নিয়েছে রোবট। মোট ২০টি দলের রোবট প্রতিযোগী এতে অংশ নেয়। রোবটদের জন্য আলাদা ট্র্যাকের আয়োজন করা হয়েছিল, তবে মানুষ আর রোবট একই সময় দৌড় শুরু করে।
মোট ২১ কিলোমিটারের কিছুটা বেশি দূরত্বের হাফ ম্যারাথন সম্পূর্ণ করেছে বেশ কিছু রোবট, অনেকগুলোই মাঝপথে নষ্ট হয়ে যায়। যদিও গবেষকরা একে ব্যর্থতা নয়, বরং গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উৎস হিসেবে দেখেছে। মানবসদৃশ রোবট নিয়ে কাজ করছে বেশ কিছু চীনা প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। কয়েক মাস ধরে রোবটের সাইকেল চালানো বা মার্শাল আর্ট চর্চার ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল।
চীনা গণমাধ্যম একে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাব্য চালিকাশক্তির একটি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ম্যারাথনে রোবটদের অংশগ্রহণ এতে যুক্ত করেছে নতুন এক মাত্রা। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তৈরি রোবটও ছিল এই ম্যারাথনে। মোট ১২ হাজার মানুষ এই দৌড়ে অংশ নিয়েছিল।
প্রত্যেকেই রোবটদের ছাড়িয়ে বহু আগেই ম্যারাথন শেষ করতে সক্ষম হয়। ২১টি রোবটের মধ্যে মাত্র ছয়টি শেষ পর্যন্ত সচল ছিল। ম্যারাথনে নামার পর কিছু রোবটের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যায়, কয়েকটি অতিরিক্ত গরম হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। রোবটগুলোর অনুমতি ছিল ব্রেক নিয়ে ব্যাটারি বদল করার। দৌড়বিদদের জন্য যেহেতু পানি খাওয়ার ব্রেক নেওয়ার অনুমতি আছে, ব্যাটারি বদলকেও তাই ম্যারাথনের নিয়মের মধ্যে ধরা হয়েছে। যন্ত্রাংশ বদল করলে ছিল ১০ মিনিট পেনাল্টি।
প্রথম স্থান পেয়েছে বেইজিং হিউম্যানয়েড রোবট ইনোভেশন সেন্টারের (বিএইচআরআইসি) তৈরি রোবট তিয়াংগং আলট্রা। দুই ঘণ্টা ৪০ মিনিটে এটি পুরো ২১ কিলোমিটার দৌড়াতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে মানব দৌড়বিদদের মধ্যে পুরুষ বিজয়ী একই দূরত্ব পাড়ি দেন মাত্র এক ঘণ্টা দুই মিনিটে। যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স, এআই এবং রোবটিকসের অধ্যাপক অ্যালান ফার্ন জানান, রোবটগুলো যে সময়সীমার মধ্যে দৌড় শেষ করতে পেরেছে, সেটি দেখেই তিনি মুগ্ধ।
বিএইচআরআইসির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা ট্যাং জিয়ান বলেন, তিয়াংগং আলট্রার মূল শক্তি ছিল লম্বা পা এবং মানুষ যেভাবে ম্যারাথনে দৌড়ায় সেটি অনুকরণ করতে পারে এমন অ্যালগরিদম। ২১ কিলোমিটার ম্যারাথন শেষ করতে মাত্র তিনবার ব্যাটারি বদলাতে হয়েছে রোবটটিকে। তবে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীনও হয়েছিল এটি। তাই একজন সাহায্যকারীরও প্রয়োজন হয়েছে।
দৌড় শুরু হওয়ার পরপরই কিছু রোবটকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যেতে দেখা যায়। যেসব রোবটের রিমোট কন্ট্রোল ছিল, তাদের সাহায্যকারীর দরকার পড়েনি। রোবটদের কারণে মানব প্রতিযোগীদের কোনো সমস্যা হয়নি, বরং অনেকেই নিজের লেন ছেড়ে রোবটদের সঙ্গে ছবি তুলতে শুরু করেন।
চীনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেও অনেক প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিজস্ব মানবসদৃশ রোবট তৈরি করছে। জাপানও পিছিয়ে নেই। চীনের শিল্প ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় মানবসদৃশ রোবটিকস শিল্পকে ‘প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার নতুন দিগন্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ২০২৩ সালে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাণিজ্যিক পর্যায়ে উৎপাদন এবং প্রয়োজনীয় উপাদান ও যন্ত্রাংশের জন্য নির্ভরযোগ্য সরবরাহ নিশ্চিতে কাজ করছে দেশটির সরকার। এই ম্যারাথনের আয়োজনেও ছিল চীন সরকার। কর্তৃপক্ষ একে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
এআই যুদ্ধে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়নত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিপসিকের মাধ্যমে গত বছরই বিশ্বকে চমক দিয়েছে চীন। এবার মানবসদৃশ রোবটে দেশটির অগ্রগতি এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। চীন চাচ্ছে ২০২৭ সালের মধ্যে এআই ও রোবটিকসে পুরো বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে।
পূর্বকোণ/ইবনুর