দুই মাসে চাঞ্চল্যকর তিন খুনের দায়ে অভিযুক্ত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ ছেলেবেলা থেকেই বেপরোয়া ও একরোখা স্বভাবের। কোন ধরনের পারিবারিক অনুশাসন না পাওয়া সাজ্জাদ গ্রাম থেকে কিশোর বয়সেই চলে আসে হাটহাজারীর আমানবাজার এলাকায়। সেখানেই যুক্ত হয় দুবাই থাকা আট হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আরেক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদের অনুসারী সরওয়ার ও ঢাকাইয়্যা আকবরের সাথে। দুবাই থাকা সন্ত্রাসী বড় সাজ্জাদের নির্দেশে হাটহাজারী, বায়েজিদ, চান্দগাঁও এবং পাঁচলাইশ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি চলছিল নীরবে। পুরো গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল সরওয়ার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এলাকার আধিপত্য ও চাঁদাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিগত ৭-৮ মাস আগে ছোট সাজ্জাদের সাথে বিরোধ বাঁধে সরওয়ারের। একটি ভবন থেকে মোটা অংকের চাঁদা নিয়েছিল তারা। কিন্তু চাঁদার ভাগ পায়নি ছোট সাজ্জাদ ও ঢাকাইয়্যা আকবর। বিষয়টি নিয়ে তাদের মাঝে বিরোধ বাঁধলে প্রথমে ঢাকাইয়্যা আকবর ও পরে চান্দগাঁও থানা পুলিশের হাতে একটি অস্ত্র মামলায় ছোট সাজ্জাদ গ্রেপ্তার হয়।
অভিযোগ ওঠে, দু’জনকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয় সরওয়ার। আকবরকে জামিন করে সরওয়ার নিজের গ্রুপে নিয়ে নেয়। কিন্তু একরোখা ছোট সাজ্জাদ বিরোধে জড়ায় সরওয়ারের সাথে। অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি সে কোনমতেই মেনে নেয়নি। জামিন পাবার পর বড় সাজ্জাদের ছত্রছায়ায় আলাদা গ্রুপ গঠন করে ছোট সাজ্জাদ। বিরোধ শুরু হয় সরওয়ার ও ঢাকাইয়্যা আকবরের সাথে।
ছোট সাজ্জাদের গ্রুপ যোগ দেয় মোহাম্মদ হাসান, খোরশেদ ও দুবাই থাকা বড় সাজ্জাদের ভাই খোকনের ছেলে মোহাম্মদসহ আরও বেশ কয়েকজন। দুবাই বসে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে বড় সাজ্জাদ। বিরোধের জেরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সরওয়ারের অনুসারী আনিস ও মাসুদ কায়সারকে গত ২৯ আগস্ট একইদিনে গুলি করে হত্যা করা হয়। জোড়খুনের ঘটনায় নাম আসে ছোট সাজ্জাদের।
এ ঘটনার দুই মাসের মাথায় গতবছরের ২১ আগস্ট চান্দগাঁও শমসের পাড়ায় সরওয়ারের অনুসারী তাহসীন নামে আরও একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনজনই ছিল ইট, বালি সরবরাহকারী। মূলত এ তিন খুনের ঘটনার পর থেকে আলোচনায় আসে ছোট সাজ্জাদ। পরবর্তীতে সরওয়ার ও ঢাকাইয়্যা আকবরকে দেখে নেয়ার কথা জানিয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্টও দেয় সাজ্জাদ। সাজ্জাদ এবং সরওয়ার বিএনপির শীর্ষ দুই নেতার ছাত্রছায়ায় চলে যায়।
ছেলেবেলা থেকেই বেপরোয়া সাজ্জাদ: সাজ্জাদের পুরো নাম সাজ্জাদ হোসেন ওরফে রিমন। কেউ কেউ তাকে ভাগিনা সাজ্জাদ, আবার কেউ বুড়ির নাতি বলে ডাকে। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৫ মামলার আসামি সাজ্জাদ একরোখা স্বভাবের। সাজ্জাদের ঠিকানা হাটহাজারী পূর্ব শিকারপুর সোনামিয়া সওদাগরের বাড়ি। তার বাবার নাম মো. জামাল ও মায়ের নাম রুনা বেগম।
সাজ্জাদ কখনও মা-বাবার স্নেহ, মায়া-মমতা পায়নি। ছেলেবেলাতেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তার বাবা-মায়ের। গতকাল সোমবার শিকারপুর ইউনিয়নের সাজ্জাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিলের মাঝখানে একটি ঝুপড়িঘর। সেই ঘরেই থাকে সাজ্জাদের প্রতিবন্ধী মা ও নানি রেহেনা (৭০)।
প্রতিবেশী জামশেদুল ইসলাম জানান, এক ভাই এক বোনের মধ্যে সাজ্জাদ বড়। বোনের বিয়ে হয়েছে। নানির কাছেই মূলত বড় হয়েছে সাজ্জাদ। এ কারণে তাকে এলাকার লোকজন বুড়ির নাতি বলে ডাকে। স্থানীয় মাদ্রাসায় ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা সাজ্জাদ ছেলেবেলা থেকেই বেপরোয়া স্বভাবের। প্রতিবেশীর ক্ষেতখামারে চুরি করতে গিয়ে পিটুনিও খেয়েছে অনেকবার।
জামশেদ জানান, সাজ্জাদের নানার বাড়ি হাটহাজারীর চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের নজু মিয়া সওদাগরের বাড়ির পাশে। সেখান থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে শিকারপুর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডে বিলের মাঝখানে একটি ঝুপড়িঘর বেঁধে সাজ্জাদকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন তার নানি। আট-দশ বছর আগে এলাকা ছাড়ে সাজ্জাদ। মাঝে মাঝে একটি মোটরসাইকেল নিয়ে নানির কাছে আসতো। তবে বেশিক্ষণ অবস্থান করতো না। এলাকায় কারও ক্ষতি করেনি।
সাজ্জাদের নানি রেহেনা বেগম জানান, অনেক কষ্টে আর অবহেলায় বড় হয়েছে আমার নাতি। ছেলেবেলাতেই তার মাকে ছেড়ে চলে গেছে তার বাবা। মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে সাজ্জাদকে বড় করেছি। টাকাপয়সার অভাবে লেখাপড়া তেমন করাতে পারিনি। স্থানীয় মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। ৮-১০ বছর আগে সে চট্টগ্রামে চলে যায়।
পূর্বকোণ/ইব