চট্টগ্রাম শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫

“মংলা বন্দরে মাইন দিয়ে ৬ জাহাজ ধ্বংস করেছি”

কবির হোসেন, কাপ্তাই

১৪ মার্চ, ২০২৫ | ২:০০ অপরাহ্ণ

রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবিউর রহমান (৭৭)। ১৯৫৫ সালের ২২ মে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার শিবচরে তিনি জন্মগ্রহণ করলেও দীর্ঘসময় কাপ্তাইয়ে বসবাস করে আসছেন। স্ত্রী ফেরদৌস আরা বেগম, ৩ ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার।

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবিউর রহমান ১৯৭১ সালের নৌ-কমান্ডো হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে তিনি জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ১৭ বছর। পিতাকে হারিয়ে ওইসময় তিনি তাঁর মামার বাড়ি বাড়বকুণ্ডে চলে আসেন এবং সেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি কেমিকেল কারখানায় চাকরিও করতেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আবিউর রহমানসহ ওই কারখানার শ্রমিক, কর্মচারীরা সকলে ঢাকা চট্টগ্রাম ট্রাঙ্ক রোড অবরোধ করেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করে তখন তিনি মামার বাড়িতে গিয়ে দেখেন সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। পরে সিন্ধান্ত নেন, ভারতে চলে যাবেন। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে লাকসাম থেকে চলে যান ভারতে।

 

তিনি আরো জানান, ২৯ মার্চ ভারতের সাতবাড়িয়া বর্ডার পার হওয়ার সময় তিনি ভারতের বিএসএফ’র নিকট গ্রেপ্তার হন। পরে বিএসএফ সদস্যরা সবকিছু যাচাই করে আগরতলা রিফিউজি ক্যাম্পে তাঁকে হস্তান্তর করেন। পরে সেখান থেকে আসামে পাঠানো হয় তাঁকে। সেখানে ভারতের কাঁঠালিয়া রিফিউজিকে ক্যাম্পে আসেন। সেখান থেকে তাঁকে নেওয়া হয় আখাউড়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। তিনিসহ সেখানে ৪০ জন অবস্থান করছিলেন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য। সেখানে থেকে তাঁদের কুমিল্লা মতিনগর ক্যাম্পে নিয়ে এসে প্রায় ১ সপ্তাহ গ্রেনেড নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

 

কিন্তু উনাদের সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে না পাঠিয়ে আবারো ভারতের কাঠালিয়া বড় মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এক পর্যায়ে ভারতীয় সৈন্যরা ওখানে যাচাই করে আবিউর রহমানসহ একটি চৌকশ দলকে বিমানে করে ভারতের মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক পলাশীতে নিয়ে যায়। সেখানেই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কমান্ডো ট্রেনিং নেন আবিউর রহমান। বিশেষ করে পানির নিচে থেকে কিভাবে মাইন, গ্রেনেড দিয়ে জাহাজ ধ্বংস করা হবে সেই বিশেষ ট্রেনিংটি সেখানে দেওয়া হয়েছিলো। পরে ভারতীয় সৈন্যরা সিন্ধান্ত নিলো আবিউর রহমানসহ তাঁদের অপারেশেন জ্যাকপটের জন্য বাংলাদেশে পাঠানো হবে।

 

১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট ভারতের হাসনাবাদ দিয়ে সুন্দরবন হয়ে কুশখালী একটা ক্যাম্পে পৌঁছান তারা। সেখানে সিন্ধান্ত হলো মংলা সমুদ্র বন্দরে থাকা বিদেশি জাহাজ ধ্বংসের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের সহযোগী জাহাজগুলো ধ্বংস করা হবে। সেই সিন্ধান্ত অনুয়ায়ী ওই টিমের লেফটেন্যান্ট কর্নেল বদি আলমের নেতৃত্বে আবিউর রহমানসহ একটি টিম সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন উত্তাল সাগরে অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা অভিযান শুরু করেন। এবং পরপর বিভিন্ন দেশের ৬টি জাহাজ ধ্বংস করেন তারা। এদিকে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এভাবে একের পর এক সফল অভিযান শেষে তারা সুন্দরবন এলাকাতে অবস্থান করছিলো।

 

এদিকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। নৌ কমান্ডো বীর মুক্তিযোদ্ধা আবিউর রহমান গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে অসুস্থ মা বেঁচে থাকতে দেখে তিনি অনেক আনন্দিত হন। কিন্তু এই দুঃসাহসী অভিযানে তিনি বেদনাভরে স্মরণ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধে হারানো সেই আপনজনদের। তিনি আরও জানান চট্টগ্রামের নৌকমান্ডোর তালিকায় তার নাম ৯ নম্বরে এবং বর্তমানে আন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম রয়েছেন ৪ নম্বরে।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট