চট্টগ্রাম শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫

গরু চুরির হিড়িক

নির্ঘুম রাত কাটছে হাটহাজারী-ফটিকছড়ির খামারিদের

নাজিম মুহাম্মদ, খোরশেদ আলম শিমুল, মোরশেদ মুন্না

১৪ মার্চ, ২০২৫ | ১২:৪২ অপরাহ্ণ

খামারের লোহার গেটে তালা দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন তিন কর্মচারী নুর উদ্দিন, ফারুক ও ফয়েল। মধ্যরাতে মুখোশ পরা তিন ব্যক্তি ঘুমন্ত এই তিন কর্মচারীর হাত পা-বেঁধে অস্ত্র তাক করে আটকে রাখে। মুখোশ পরা বাকি তিন ব্যক্তি খামার থেকে দুটি ফিজিয়ান জাতের গাভী বের করে নিয়ে যায়। প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা মূল্যের দুটি গরু নিয়ে গেছে তা নয়- ঘটনার আগে তারা খামারের লোহার গেটের তালা কেটে সিসি ক্যামেরাও ভাঙচুর করে।

 

গত ১৪ জানুয়ারি সংঘটিত এ ঘটনায় খামারের মালিক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী হাটহাজারী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনার প্রায় আড়াইমাস পার হতে চললেও পুলিশ গরু কিংবা গরু চোর- কারও কোনো হদিস পায়নি।

 

হাটহাজারীর ধলই ইউনিয়নের আমিনুর রহমান বাড়ির কৃষক আবুল কাশেমের ছেলের বিয়ের দিন ধার্য ছিল গত ১৯ ফেব্রুয়ারি। আগের রাতে মেহেদী অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন সবাই। এরমধ্যে চোরের দল কাশেমের দুটি গাভী ও একটি বাছুর নিয়ে যায় মধ্যরাত থেকে ভোরের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক কাশেমের পরিবারের আনন্দটাই যেন ফিকে হয়ে যায়। এক বছরের বেশি সময় ধরে পালন করা শখের গাভী আর বাছুর হারিয়ে কাশেমের চোখ দুটি জলে ছল ছল করে ওঠে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও গরুগুলো আর মিলেনি।

 

গত সোমবারও হাটহাজারী সদর এলাকা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার সময় সিএনজি ট্যাক্সিতে তুলে একটি গরু নিয়ে যায় চোরের দল। পৌর এলকার আলিপুর চার নম্বর ওয়ার্ডের আমিনুর রহমান কেরানি বাড়িতে চুরির এ ঘটনা ঘটে।

 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রিয়া চৌধুরী জানান, সড়কের পাশে তিনটি গরু বাঁধা ছিল। ইফতারের আগে একটি সিএনজি ট্যাক্সি নিয়ে আসে তিনজন লোক। তারা একটি গাভী ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে যায়। তিনি মনে করেছেন গরুর মলিক হয়তো কোথাও গরু নিয়ে যাচ্ছেন। পরে জানতে পারেন একটি গরু চুরি হয়েছে।

 

হাটহাজারী উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুজন কানুনগো জানান, হাটহাজারীতে গরুর খামার রয়েছে ৩৯০টি। ঈদ-উল আজহাকে কেন্দ্র করে ৫৩৪ জন খামারি গরু মোটাতাজাকরণ করেন। রমজানের শুরুতে তারা বাজার থেকে গরু কিনেন। গরু চুরি আশংকাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় এ বছর তেমন গরু কিনেননি খামারিরা।

 

হাটহাজারী ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশনের সভাপতি হাফেজ ওবাইদুর রহমান জানান, খামারিরা নির্ঘুম রাত যাপন করছে। অস্ত্রের মুখে খামারের কর্মচারীদের বেঁধে গরু নিয়ে যাচ্ছে ডাকাতদল। তারা ঘটনার আগে ভেঙে ফেলছে সিসি ক্যামেরা। আতংকে কর্মচারীরা খামারে থাকতেই চাইছে না। মেখল, মাদার্শা, ফতেপুর ও আলমপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি গরু চুরির ঘটনা ঘটছে। খামারিরা পুলিশের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলছে।

 

তিনি বলেন, ৭-৮ মাস আগে ফতেয়াবাদ এলাকার কাশেম নামে এক খামারির এক রাতে ছয়টি গরু চুরি হয়। তিনি বিষয়টি থানায় জানান। পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় তাকে নিয়ে অভিযান চালায়। কাশেমের আরো ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। এরমধ্যে তার খামার থেকে আরো তিনটি গরু চুরি হয়। রাগে-ক্ষোভে কাশেম আর থানার দিকে পা মাড়াননি। ছড়ারকুলের আর এন ডেইরি থেকে দেড়মাস আগে অস্ত্রের মুখে কর্মচারীদের জিম্মি করে তিনটি গরু চুরি করা হয়। মালিক থানায় মামলা দায়ের করেছেন- অতটুকুই। পুলিশ গরুগুলো উদ্ধারে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

 

জানতে চাইলে হাটহাজারী থানার পরিদর্শক (ওসি) আবু কাউসার মোহাম্মদ হোসেন চিরচরিত নিয়ম অনুযায়ী বলেন, বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখছি।

 

তিনমাসে ১৩ গরু চুরি ফটিকছড়িতে :

 

শুধু হাটহাজারী নয়। পার্শ্ববর্তী উপজেলা ফটিকছড়িতেও আশংকাজনকভাবে বেড়েছে গরু চুরি। চোরের হাত থেকে রেহায় পাচ্ছে না বাছুরও। কোথাও না কোথাও দুই একদিন পর পর চুরি হচ্ছে গরু। চুরি আতংকে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন খামারিরা। রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন খামার। থানায় মামলা করেও পাচ্ছেন না কোনো প্রতিকার।

 

ফটিকছড়ি উপজেলায় গত তিন মাসে ১৩টি গরু চুরি হয়েছে। সবকটি ঘটনা রাতের বেলায় গোয়াল ঘরের তালা ভেঙে ঘটেছে। এতে ফটিকছড়িতে গরু পালনে ও মোটাতাজাকরণে অনীহা বাড়ছে। শংকিত হয়ে পড়ছেন খামামিরা।

 

জানা যায়, গত ১৬ জানুয়ারি ফটিকছড়ি পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের কেএম টেক এলাকার আতাউল হক চৌধুরী বাড়ি থেকে একরাতে ছয়টি গরু চুরির ঘটনা ঘটে। ওই এলাকার কৃষক মো. ইউসুফ ও বদিউল আলমের পালিত গরুগুলো গোয়াল ঘরের তালা ভেঙে নিয়ে যায় চোরের দল। চুরি হওয়া গরুর মধ্যে বড় ষাড় রয়েছে একটি, গাভী তিনটি ও বাছুর দুটি। যার বাজার মূল্য আনুমানিক পাঁচ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

 

এরপর গত ২৯ জানুয়ারি উপজেলার পাইন্দং ইউপির ৪নং ওয়ার্ডের পূর্ব হাইদচকিয়া গ্রামের খালাসির বাড়ির কৃষক মো. সরোয়ারের একটি গাভী, একটি ষাড় এবং একটি বাছুর চুরি করে চোরের দল। মধ্যরাতে গোয়াল ঘরের তাল ভেঙে এ ঘটনা ঘটেছে। গরুগুলোর আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় তিন লাখ টাকা।

 

সর্বশেষ গত ২২ ফেব্রুয়ারি ফটিকছড়ির রোসংগিরী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের হাজি মুসার বাড়িতে কৃষক সেলিমের চারটি গরু চুরি হয়। চোরের দল মধ্যরাতে গোয়াল ঘরের তালা ভেঙে একটি গাভী, একটি ষাড় এবং একটি বাছুর নিয়ে যায়। যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৩ লাখ টাকা। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে থানায় দুটি অভিযোগ নিয়ে দায় সেরেছে।

 

জানতে চাইলে ফটিকছড়ি থানার ওসি নুর আহমদ জানান, যতটুকু জানতে পেরেছি দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি গরু চোর সিন্ডিকেট স্থানীয়দের সহায়তায় ঘটনাগুলো করছে এবং পার্বত্য অঞ্চল খাগড়াছড়ির দিকে গরুগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবকিছু নজরদারির মধ্যে রয়েছে। রাতে পুলিশ টহল বাড়ানো হয়েছে।

 

ফটিকছড়িতে ৩৬টি দুগ্ধ খামার ও ১০টি মোটাতাজাকরণ খামার রয়েছে। দুগ্ধ খামারগুলোতে গরু মোটাতাজাকরণ কার্যক্রমও চলে। এছাড়া উপজেলার বেশিরভাগ কৃষক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে গরু মোটাতাজাকরণ করে থাকে। গরু চুরির ঘটনায় কৃষক, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও খামারিদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

 

জানতে চাইলে ফটিকছড়ি উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ আব্দুল মুমিন জানান, আমাদের পরিসংখ্যানের বাইরেও কিছু খামারি রয়েছে। তবে, ফটিকছড়িতে গরু ক্রয়-বিক্রয় কিংবা গরু উৎপাদন করে বিক্রি করার মত কোনো একক বাণিজ্যিক খামার নেই। গরু চুরির ঘটনা আংশকাজনক হারে বেড়েছে।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট