চট্টগ্রাম শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫

সামাজিক ব্যাধি নারী ও শিশুধর্ষণ এবং আমাদের করণীয়

ফারিহা জেসমিন ইসলাম

১৩ মার্চ, ২০২৫ | ২:৫২ অপরাহ্ণ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেদিন এক মায়ের স্ট্যাটাস দেখছিলাম আর আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। ‘আমি আমার মেয়েকে বাংলাদেশের বাইরে পার করে দিয়েছি, আপনারাও আপনাদের মেয়েদের পার করে দেন, নইলে লুকাবেন কোথায়?’ এই স্টেটমেন্টটা ইঙ্গিত দিচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নারীদের নিরাপত্তার জন্য কতোটা প্রতিকূল।

 

প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্ষণের খবর আসছে। সিভিয়ার ইভ টিজিং, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এরপর হত্যা যেন একটা নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিশোর গ্যাং, ইন্টারনেট গ্যাম্বলিং ইত্যাদি এখন টক অফ দ্যা টাউনে পরিণত হয়েছে। সবমিলিয়ে একটা বড়রকমের মোরাল ক্রাইসিস এর মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। আজকাল কোন প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে চোখ রাখা যায় না, সবখানেই মর্মান্তিক ধর্ষণের লোমহর্ষক বর্ণনা। আটবছরের শিশু আছিয়া থেকে শুরু করে রেহাই নেই আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা কারোর।

 

সমগ্র দেশে যেন ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। পরিস্থিতি ভয়ঙ্কররকম উদ্বেগ জনক। মনে প্রশ্ন জাগে কেন এমন হচ্ছে? কেন একদল পুরুষ এমন ক্ষুধার্ত হায়েনার মত নিরীহ মা-বোনদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে? আচমকাই নারীরা কেন স্বাধীনভাবে দেশের কোথাও চলাচল করতে পারছে না। ধর্মের দোহাই দিয়ে, পর্দার দোহাই দিয়ে, শালীনতার দোহাই দিয়ে তারা নারীর শরীরের উপর এভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে কেন?

 

মেয়েরা অশালীন পোশাক পড়ে, রাতের বেলাও অবাধে বিচরণ করে, পুরুষদের ধর্ষণের মত কাজে প্ররোচিত করে ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযোগ সমাজ তথা পুরুষেরা করলেও প্রকৃত কারণ আসলে কি? ছোট্ট আসিয়া কি তার দুলাভাই কিংবা বোনের শ্বশুরকে অশালীন পোশাক পড়ে প্ররোচিত করেছিল? এর জবাবে আপনারা কি বলবেন? আসলে উদ্বেগজনক সত্য হল নৈতিকতার অভাব মানুষকে তথা কিছু পুরুষকে বর্বর হায়েনায় পরিণত করে এবং তারা নিরীহ নারীদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে, ভয়ঙ্কর দানবদের মত নারীদের আক্রমণ করে পাশবিক আনন্দ পায়।

 

আমাদের সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে এই জঘন্যতম অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি না থাকায় এসব নরপিশাচগুলো আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়। উল্টো ধর্ষণের শিকার হওয়া শিশু, নারী কিংবা তার পরিবারের উপর চড়াও হয়। এমন শত শত ধর্ষণের ঘটনা প্রতিদিন গোটা দেশজুড়ে সংগঠিত হয়। হয়ত গুটিকয়েকের খবর আমাদের কানে আসে যেগুলো মিডিয়ে কাভার করে বাকিগুলো চাপা পড়ে যায়। কথা হল, এমন গুরুতর একটা সামাজিক ব্যাধির বিস্তার এবং সম্পূর্ণ রুখে দেয়ার জন্য আমাদের করণীয় কি? এই সামাজিক ব্যাধি দূর করা না গেলে আমাদের কন্যাসন্তানদের জীবন অন্ধকারে ঢেকে যাবে। তাদের কি একটি নিরাপদ সামাজিক জীবন যাপনের অধিকার নেই?

 

এই সামাজিক ব্যাধি রুখতে আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে নিজ নিজ জায়গা থেকে টেকসই ভূমিকা পালন করতে হবে। একটা রাষ্ট্রের জনগণের নৈতিক চরিত্র যদি উন্নত করা যায় তাহলে এমন সামাজিক ব্যাধি শেষমেশ পরাজিত হয়। রাষ্ট্রের ভ‚মিকা হল যথাযথ আইনি সুরক্ষা প্রদান করা, ধর্ষণকারীর জন্য দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি এমনকি মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা রাখা এবং এবং এই বিচার সুনিশ্চিত করা। শিশুদের জন্য পাঠ্যপুস্তকে উপযুক্ত নীতি-নৈতিকতার শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা। সমাজের উচিত ভাল অনুশাসনের চর্চা করা, সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামজিক প্রতিষ্ঠানে অন্যকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার মত উন্নত আচার-আচরণের চর্চা করা।

 

আমি বিশেষ করে বলব সমাজের, রাষ্ট্রের আদিশিক্ষালয় পরিবারের কথা। শিশুর নৈতিক চরিত্র গঠনে পরিবারই সবচে’ শক্ত এবং উন্নত ভূমিকা পালন করতে পারে। শিশুকে সুমানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে একজন বাবার কথা বলব, বলব ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন সবার কথা। আর বলব মা, হ্যাঁ একজন মা-ই সবচে’ বেশী চিরন্তন ভ‚মিকা পালন করতে পারেন সন্তানকে যথার্থ মানবিক শিক্ষায়, নৈতিক সুশিক্ষায় তৈরি করতে। ছোটবেলা থেকেই শিশু ঘরে-বাইরে কি দেখছে এবং কি শিখছে সেসবের দিকে নজর দিন। ছেলেমেয়েদের জীবনমুখী বাস্তব শিক্ষা দিন, দিতে হবে। আপনি একজন নারীর স্তনকে আড়াল করতে গিয়ে তাকে নারীর গোপনীয়তার প্রতি আগ্রহী করে তুলছেন কিনা না বুঝতে হবে।

 

আমাদের দেশে আমরা কিন্তু সামজিক লজ্জার দোহাই দিয়ে মেয়েদের সব ব্যাপারগুলোকে ছেলেদের থেকে লুকিয়ে রাখি। নারীর স্তনকে লুকিয়ে রাখি, পিরিয়ডকে লুকিয়ে রাখি, পোশাক-পরিচ্ছদকে লুকিয়ে রাখি। ফলে একটা কৌতূহলের বিশাল অন্ধকার জগত ছেলেদের জন্য তৈরি হয়ে যায়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কিন্তু ছেলেমেয়েরা স্কুলে একটা স্ট্যান্ডার্ড-এ উঠার পরে তাদের জন্য যৌনশিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। অন্ধকার দিকগুলোতে আলো ফেলে তাদের জানানো হয় নারী পুরষের কেমিস্ট্রিটা। ফলে এসব দেশে নারীর প্রতি যৌনসহিংসতা কদাচিৎ ঘটে থাকলেও আমাদের দেশের মত দিনে দুপুরে, রাতে বিরেতে এমন হায়েনার মত ধর্ষণ সংঘটিত হয় খুব কম।

 

সব মানুষই মানুষ। নারী পুরুষের কিছু শারীরিক পার্থক্য রয়েছে যা নারীকে নারী এবং পুরুষকে পুরুষ করেছে। তার শারীরিক গঠন সম্পর্কে শিশুকে সঠিক সময়ে সঠিক করে বুঝিয়ে বলুন। রাখ রাখ, ঢাক ঢাক করে আর কতো? একসময় সে এগুলো এমনিতেই শিখে যায়। স্কুলে বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে শিখবে, বাসার বাইরে যাদের সাথে মিশে তাদের থেকে শিখবে, প্রতিবেশিদের দেখে শিখবে, টেলিভিশনে চুমুর দৃশ্য দেখে শিখবে, গল্প উপন্যাস পড়ে শিখবে- সে শিখবেই। তবে তাতে করে ভালভাবে শিখবে না।

 

নারীকে যৌনবিষয়, নারীর শরীরকে যৌনবস্তু হিসেবে বুঝতে শিখবে, শিখবে নারী গোপনীয়, ভোগ করার পণ্য। তারচে’ মঙ্গল নারীকে গোপন করে না রেখে ইতিবাচক উপায়ে তাকে নারী সম্পর্কে জানান। তাকে পর্যাপ্ত শালিনভাবে যৌন আচার, শিক্ষা দিন। তাকে উচিতবয়সে ধর্ষণ সম্পর্কে জানান, জানতে দিন। তাকে অন্ধকারে রাখবেন না। যুগ বদলে গেছে। প্রযুক্তি মানুষের দোরগোড়ায় সব ভাল, খারাপ, সুবিধা অসুবিধাকে এনে দিয়েছে। প্রযুক্তি হাতে হাতে মোবাইল ফোন এনে দিয়েছে। প্রযুক্তি ফোনের ভেতর ডেটিং সাইট এনে দিয়েছে, পর্নোগ্রাফি এনে দিয়েছে। আপনার সন্তানকে আপনি চাইলেও বিজ্ঞান, প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে পারবেন না। পরনোগ্রাফি থেকেও দূরে রাখতে পারবেন না। তাই এখন প্রয়োজন বিষ দিয়ে বিষ তোলার মত ব্যবস্থা। আগেভাগে আপনার সন্তানের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

 

যৌনশিক্ষা দিয়ে তাকে অন্ধকার থেকে আলোতে আনতে পরিবারের বিকল্প নেই কোন। নারীর শরীর নিয়ে তার লোভ, অন্ধাকারচ্ছন্ন ধারণা এসব মুছে দিতে হবে। যতদিন নারীদের নিয়ে তারা নেতিবাচকভাবে আগ্রহী হয়ে রইবে ততদিন সমাজ থেকে ধর্ষণ যাবে না। যতদিন তারা নারীদের মানুষ না ভেবে মাল ভেবে যাবে ততদিন আসলেই ধর্ষণ যাবে না। ছোটবেলা থেকেই সুস্থ সামাজিক এবং নৈতিক শিক্ষা পেলে একজন শিশু বড় হয়ে ধর্ষক হয়ে বেড়ে উঠবে না বরং সে ধর্ষণের প্রতিবাদ করবে, ধর্ষণকে সে রুখে দিবে। আর পরিবার এবং বাবা মা হল সেই সুস্থশিক্ষা দেবার একমাত্র জায়গা।

 

পরিশেষে এমন সামাজিক ব্যাধি রুখে দেবার ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসনের কথাটা বলে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি এবং সময়ের দাবীও বটে। আজকাল বেশি আধুনিকতার চর্চা করতে গিয়ে আমরা যার যার ধর্মীয় অনুশাসনকে তেমন মাথায় রাখি না। কিন্তু এই তুমুল অস্থির বাস্তবতায় ধর্মকে ভুলে যাওয়া মানে পাপাচার কে প্রশ্রয় দেয়া। ধর্মীয় অনুশাসন আমাদের সঠিক, সুন্দর পথে চলতে সাহায্য করে। তাই যতটা সম্ভব আমাদের উচিত নিজ নিজ ধর্মকে সম্মান দেখিয়ে চলা। আমাদের সমাজে যে আঁধার আসন্ন কিংবা এসেছে নৈতিক শিক্ষা উন্নত করা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় নেই।

 

লেখক : কবি, গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক; সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট