সিলেটের কানাইঘাটের পাঁচ বছরের শিশু মুনতাহা আক্তার। গত ৩ নভেম্বর নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের সাতদিন পর ডোবা থেকে মুনতাহার লাশ নিয়ে পুকুরে ফেলতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন এক নারী। লাশ উদ্ধারের সময় মুনতাহার শরীরে কাদা লেগে ছিল। গলায় রশিজাতীয় কিছু পেঁচানো ছিল। তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যারও আলামত পায় পুলিশ। ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের তালিকায় মুনতাহার সাবেক গৃহশিক্ষকও রয়েছেন।
শুধু মুনতাহা নয়। আরও অনেক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। পল্লবী এলাকায় বিজয় ও মুসা নামের দুই শিশুকে গলাকেটে হত্যা করেন তাদের বাবা আহাদ। তাদের একজনের বয়স ৭ বছর অন্যজনের ৪ বছর। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি শিশুকে নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরে ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, দাম্পত্য কলহ, নিখোঁজের পর হত্যাসহ নানা কারণে হত্যা করা হচ্ছে। অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে।
শিশু হত্যার পেছনে বাবা-মা, ভাই-বোন থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, ব্যবসায়িক পার্টনার ও ভাড়া করা খুনিরা জড়িত। এ ছাড়া শিশুদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। কিডনি পাচারকারী চক্রেরও টার্গেট কোমলমতি শিশুরা। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক) এর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০১৬ সাল থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৯ বছরে ৪ হাজার ৭৬২ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে।
এরমধ্যে ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি ৬২০ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। পরিসংখ্যান মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ৪৮২ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ২০২৩ সালে ৪৮৫ শিশুকে। ২০২২ সালে ৫১৬ শিশু। ২০২১ সালে ৫৯৬ শিশু। ২০২০ সালে ৫৮৯ শিশু। ২০১৯ সালে ৪৮৮ শিশু। ২০১৮ সালে ৫২১ শিশু। ২০১৭ ৬২০ শিশু এবং ২০১৬ সালে ৪৬৫ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।
কিছুদিন আগে যশোরের ঝিকরগাছায় সাদিয়া খাতুন নামে এক শিশুকে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানায়, সাদিয়ার কানে থাকা স্বর্ণের দুল নেয়ার জন্য পরনের গেঞ্জি দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। সম্প্রতি পরকীয়ার জেরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মা ও দুই শিশুকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, শুধু শিশুরাই নয় সমাজে যেকোনো অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য বিচারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও আইনের শাসন বাস্তবায়ন করতে হবে। সমাজে এমন বার্তা দিতে হবে যাতে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।
দেশে শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়নি উল্লেখ করে অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, পরিবারে, পরিবারের বাইরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে শিশু যে সকল দিক থেকে নিরাপদ থাকবে এই বিষয়গুলো আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। এ কারণে শিশু নির্যাতন প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলছে। আমাদের সমাজে বড়দের অন্যায়, অসামাজিক বা নিয়মবহির্ভূত কোনো কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে জানলে শিশুরা হত্যার শিকার হচ্ছে। অপহরণের শিকার হচ্ছে।
মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিকারগ্রস্ত মানুষ শিশু নির্যাতন করে উল্লেখ করে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, শিশুদের নির্যাতন বা পাশবিক অত্যাচার করলে তারা নিজেদের সুরক্ষা করতে পারে না। হিংসার বশবর্তী হয়ে অপরাধীরা এসব করে। শিশুদের মন মানসিকতা খুবই দুর্বল। এজন্য অপরাধীরা শিশুদের বেছে নেয়।
পূর্বকোণ/ইব