১৯৯১ সালে ৬০০ ডলার নিয়ে আমেরিকায় এসেছিলাম মাস্টার্স করার জন্য। মামনি দিয়েছিল ৫০০ আর বাল্যবন্ধু শিল্পী সুমনা হক দিয়েছিল ১০০ ডলার। এখানে আসার পর একটা স্কলারশিপ পেয়েছিলাম স্কুল থেকে। স্কুলের লাইব্রেরিতে কাজ করতাম সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা আর দুটো অফ ক্যাম্পাস কাজ করতাম। একটি ছিল হোটেলের কাজ। প্রায় রাতেই স্কুলের বন্ধুরা রেস্তোরাঁয় আসতো আমায় সাহায্য করার জন্য। সব করতে পারতাম কিন্তু রেস্তোরাঁর মেঝে মুছতে গেলেই বুকে ব্যথা লাগত। অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে দু’বার হার্নিয়া অপারেশন করতে হয়েছিল আমাকে।
আমার মনে আছে তিন মাস কাজ করার পর ব্যাংকে হাজার তিনেক ডলার জমেছিল। মামনিকে ফোন করে বলেছিলাম যে আমি এখন লাখপতি! তখন বোধহয় ১ ডলারে ৪৩ টাকা পাওয়া যেত! (আমার ভুলও হতে পারে!)
রেস্টুরেন্টের পুরানো বাসি খাবারগুলো বাসায় নিয়ে আসতাম আর সব স্কুলের বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করতাম ইন্ডিয়ান খাবার খাওয়ার জন্য। আহা, সেই ছাত্রবন্ধুগুলোর কী আনন্দ তখন! সারা সপ্তাহ বার্গার পিজ্জা খাওয়ার পর ভাত ছিল একেবারে অমৃত সমান। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমিই ছিলাম প্রথম বাংলাদেশের ছাত্র।
সব দেশে, সব কালেই বোধহয় ছাত্র জীবনের মজাটাই অন্যরকম। পয়সার অভাবে এক কলা দুজন ভাগ করে খাওয়া। এক বীয়ার শেয়ার করা বন্ধুদের সাথে। টাকার অভাবে একজন আরেকজনের চুল কেটে দেয়া। একশলা সিগারেট ৫ জনে খাওয়া। আর মাসে একবার সব বন্ধুদের নিয়ে গানের আসর, হাহা হিহি আড্ডা।
কী মিষ্টি সেই দিনগুলি। কী আনন্দের সেই ছাত্রজীবন! বন্ধুরা এই দুটো ছবি আমার সেই ছাত্রজীবনের বড় একটা অংশ। এখানে কাজ করে টাকা জমিয়ে স্কুলের টিউশন ফিস দিতাম। মাঝে মাঝে মা’কেও কিছু পাঠাতাম।
প্রথম দিনের ইনকাম ছিল ৩০ ডলার। সেই টাকা থেকে মামনি, আমার দিদিমা, প্রেমিকা ও পরবর্তীতে স্ত্রী নীতা, বন্ধু সুমনাকে কিছু কিছু করে পাঠিয়েছিলাম। প্রবাস জীবনের প্রথম অর্থপ্রাপ্তি বলে কথা। এভাবেই হেসে খেলে, আড্ডা আর গান গেয়ে মাস্টার্স শেষ করেছিলাম!
আগামী মহিরাজ, আগামী, পুত্র আমার, ছবি দুটো তোর ট্রেজারবক্সে রেখে দিস। তোর নাতিপুতিদের দেখিয়ে বলিস তোর বাবার শিকড়ের কথা। তোর বাবার পাগলামির কথা। তোর বাবার বাংলা গান ভালোবাসার কথা, দেশপ্রেমের কথা। তোর বাবার জীবনের জয়গানে জীবনকে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা। তোর বাবার সহজ সরল দিন যাপনের কথা। জীবন সুন্দর, আনন্দম।
লেখক: মহীতোষ তালুকদার তাপস, বাংলা সংস্কৃতির নিবিড় সাধক।
পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ