পরিকল্পিতভাবে মানবসম্পদ উন্নয়ন দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে মজবুত করে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়তে কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রয়োজন রীতিবদ্ধ ও সুসংগঠিত শিক্ষা ব্যবস্থাপনা; যেখানে তাত্ত্বিক, প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন, দান খুব জরুরি। এজন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী করে ঢেলে সাজাতে হবে।
‘বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কেমন মানবসম্পদ চাই’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেছেন বক্তারা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার ফর বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (সিইউসিবিএ) অ্যালমনাই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে শনিবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সুলতান আহমেদ হলে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
সিইউসিবিএ এর অ্যালমনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইউসুফের সভাপতিত্বে এতে অতিথি হিসেবে আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এস. এম. নসরুল কদির, সিইউসিবিএ এর পরিচালক ড. মোহাম্মাদ তৈয়ব চৌধুরী, সিইউসিবিএ এলামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সজীব কুমার ঘোষ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আফতাব উদ্দিন । এছাড়া সভায় বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা, গণমাধ্যমকর্মী ও শিক্ষার্থীরা মানবসম্পদের উপর মতামত দিয়েছেন। আলোচনায় অংশ নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশনের যুগ্ম-সম্পাদক কামরুল হাসান হারুন, কনফিডেন্স সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন, সাউথ ইষ্ট ব্যাংক চট্টগ্রাম জোনাল হেড মো. রাশেদুল আমিন, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের এজিএম আরিফ আহমেদ, বিএসআরএম গ্রুপের সাপ্লাই চেইন বিভাগের প্রধান সঞ্জয় কুমার ঘোষ, একে খান এন্ড কোম্পানির মানব সম্পদ বিভাগের একেএম মাফরুল হক, হাইডেল্ডবার্গ সিমেন্টের মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান আরিফুর রহমান, ট্যালেন্ট ম্যানেজমেন্ট একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা নোমান বিন জহির উদ্দিন, দৈনিক বণিক বার্তার চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান রাশেদ এইচ চৌধুরী, ইপ্সার মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান গাজী মো. মাইনুদ্দিন প্রমুখ।
উদ্বোধনী বক্তব্যে চবির ব্যবসা প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এসএম নসরুল কদির বলেন, রাতারাতি আমরা সবকিছু পরিবর্তন করতে পারবো না। আমার বিশ্বাস আমাদের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাবে। অ্যাকাডেমিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিল্ডের জন্য তাদের তৈরি করতে হবে। বর্তমান পৃথিবীকে আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এ আইয়ের যুগ বলছি। এজন্যই শিক্ষার্থীদের আরও বেশী দক্ষ হয়ে উঠতে হবে।
বিএসআরএমের সিনিয়র ব্যবস্থাপক ফাহমিনা আসাদ বলেন, প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান না থাকলে শুধুমাত্র থিউরিটিক্যাল জ্ঞান দিয়ে জব মার্কেটে ভালো করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মমূখী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা উচিৎ।
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের কর্মকর্তা কাউসার হাসান বলেন, চ্যালেঞ্জ থাকবে, আমাদের মানিয়ে নিতে হবে। যুগোপযোগী কারিকুলাম তৈরি করতে হবে। বর্তমানে কাজ করতে দক্ষতা লাগবে, জ্ঞান লাগবে। এটার বিকল্প নেই।
বসুন্ধরা গ্রুপের উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ বলেন, আমাদের কারিকুলাম আপডেট করতে হবে। আমরা এখনো ৯০ সালের কারিকুলামে পড়াশোনা করাই। আমরা কি ধরনের স্কিল চাই সেটা বুঝতে হবে। আমাদের কমিউনিকেশন স্কিল এবং অ্যানালাইটিক্যাল স্কিল নিয়ে কাজ করতে হবে। এই জেনারেশানের শিক্ষার্থীরা দ্রুত বড় হতে চায়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের জন্য ক্যারিয়ার কাউন্সিলিং করা প্রয়োজন।
দৈনিক বণিক বার্তার চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান রাশেদ এইচ চৌধুরী বলেন, পৃথিবীতে তিনটা তত্ত্ব ব্যবহার করে দেশগুলো উন্নতির শিখরে উঠেছে। একটি হলো প্রাকৃতিক সম্পদ, দ্বিতীয়ত প্রযুক্তিগত
জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে। এছাড়া আরেকটি তত্ত্ব হলো মানবসম্পদ উন্নয়ন। পৃথিবীর অনেক দেশ শুধুমাত্র মানবসম্পদ দিয়ে এগিয়ে গেছে। আমাদের দেশে মানুষ আছে, তবে মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে না। যার কারণে বাইরে থেকে লোক এনে কাজ করাতে হচ্ছে। আমাদের সমন্বয় ও যোগাযোগ দক্ষতা খুবই দুর্বল। এসব নিয়ে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক আশফাক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন বলেন, একটি দেশের বস্তুগত সম্পদ এবং সম্ভাবনা যতই থাকুক না কেন, যতক্ষণ এ সম্পদ ও সম্ভাবনা কাজে না লাগাতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। তাই কর্মমুখী শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে আমাদের।
বক্তারা বলেন, যোগাযোগ দক্ষতা, কম্পিউটার দক্ষতা, নৈতিকতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, সব সেক্টরে নিজেকে খাপ খাওনোর মতো মানসিক শক্তি থাকতে হবে উচ্চ শিক্ষা গ্রাহণকারী শিক্ষার্থীদের। আমাদের দেশে একটি উচ্চ শিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। তবে দক্ষ মানবসম্পদ নেই। এজন্য পাশ্ববর্তী দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে অভিজ্ঞদের নিয়ে এসে বিশাল অঙ্কের বেতন দিয়ে রাখতে হচ্ছে। ভারত-শ্রীলঙ্কার মানুষরা যদি পারে, আমরা কেন পারবো না!
তারা আরও বলেন, উন্নয়ন মূলত মানুষকেন্দ্রিক। এ জন্য পল্লি উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন, কৃষি, শিল্প উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে মানুষকেই। অতএব, একটি দেশ যতক্ষণ তার বস্তুগত সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। তাই দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে আমাদের। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করতে পারলে বাংলাদেশ আর বেকারত্ব থাকবে না।
সিইউসিবিএ এর অ্যালমনাই অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা সজিব কুমার ঘোষ বলেন, বাংলাদেশ সরকার উচ্চ-শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল। আমরা যদি কোয়ালিটি শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাই তবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর যেন তার দক্ষতানুযায়ী জব সেক্টরে কাজে লাগতে পারে, আমরা সে চেষ্টা করছি। এজন্য সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
সিইউসিবিএ এর পরিচালক ড. মোহাম্মাদ তৈয়ব চৌধুরী বলেন, আমরা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারিনি। শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে শিখাতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে কিভাবে কাজ করতে হয়। এখন জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করে নার্সিং ইন্সটিটিউট করুন, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করুন তাহলেই দেশ উপকৃত হবে। আমাদের কতজন গ্রাজুয়েট প্রয়োজন তার রাষ্ট্রীয় কোনো হিসাব নেই, কোনো পলিসি কিংবা এজেন্ডাও নেই। তাহলে কিভাবে আমরা এগিয়ে যাবো? সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করেই কিভাবে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা যায়, সেটি খুঁজে বের করতে হবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিইউসিবিএ এলামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনামুল হক, এবিএম শিহাব উদ্দিন, সহ সভাপতি আমিনুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, সেমিনার ও প্রশিক্ষণ সম্পাদক মহিউদ্দিন রিয়াদ, দপ্তর সম্পাদক মোজাফ্ফর হোসেন রাহাত প্রমুখ।
পূর্বকোণ/এএইচ