চট্টগ্রাম রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

মেডিক্যাল ও স্বাস্থ্যখাতে ভার্চুয়াল এবং অগমেন্টেড রিয়্যালিটি

ড. ইকবাল আহমেদ

১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৩:৪৫ অপরাহ্ণ

ভার্চুয়াল (VR) এবং অগমেন্টেড রিয়্যালিটি (AR) প্রযুক্তি দুটি আধুনিক ডিজিটাল জগতের একটি অত্যাধুনিক উদ্ভাবন। এককথায় এগুলো আমাদের বাস্তব এবং ডিজিটাল দুনিয়ার মধ্যে মেলবন্ধন ঘটায়। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি (ভিআর) হলো একটি প্রযুক্তি, যা ব্যবহারকারীকে একটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম ত্রিমাত্রিক (3D) পরিবেশের অভিজ্ঞতা দেয়। ভিআর হেডসেট এবং কন্ট্রোলার ব্যবহার করে এই পরিবেশে প্রবেশ করা যায়, যেখানে ব্যবহারকারী বাস্তব দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক কৃত্রিম জগতে প্রবেশ করেন এবং বিভিন্ন কাজ করতে পারেন।

 

ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে ভিআর হেডসেট যেমন, Oculus Rift ev HTC Vive ব্যবহারকারীর চোখের সামনে একটি 3D ভার্চুয়াল দৃশ্য প্রদর্শন করে। সাথে সাথে হেডসেটের সেন্সর এবং ক্যামেরা ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর মাথা এবং শরীরের নড়াচড়া সনাক্ত করা হয়। তাছাড়াও ইন্টারঅ্যাকশন ডিভাইস দ্বারা হাতে থাকা কন্ট্রোলার বা গ্লাভস ব্যবহার করে ব্যবহারকারী ভার্চুয়াল জগতে বিভিন্ন কাজ করতে পারে। হাই-স্পিড কম্পিউটার সফটওয়্যার এই কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে এবং রিয়েল-টাইমে আপডেট করে। অন্যদিকে অগমেন্টেড রিয়্যালিটি (এআর) হলো আরেকটি প্রযুক্তি, যা বাস্তব পরিবেশের উপর অতিরিক্ত তথ্য, গ্রাফিক্স বা ভার্চুয়াল উপাদান যোগ করে বাস্তব জগতকে সমৃদ্ধ করে।

 

উদাহরণস্বরূপ, স্মার্টফোন বা এআর হেডসেট ব্যবহার করে ব্যবহারকারী বাস্তব জগতে অতিরিক্ত গ্রাফিক্স বা উপাদান দেখতে পান, যা তাদের অভিজ্ঞতাকে আরো কার্যকর এবং মজাদার করে তোলে।অগমেন্টেড রিয়্যালিটির কাজ করার প্রক্রিয়া মূলত ক্যামেরা ও সেন্সর দিয়ে হয়ে থাকে যেমন, এআর ডিভাইস (স্মার্টফোন, ট্যাবলেট বা এআর চশমা) এবং বিভিন্ন সেন্সরের মাধ্যমে প্রথমে বাস্তব পরিবেশ সনাক্ত করে। তারপর ডিজিটাল ওভারলে (Overlay) ট্যাকনোলজি ব্যবহার করা হয়; ওভারলে হলো এক ধরনের সফটওয়্যার বা প্রোগ্রাম যা বাস্তব জগতের উপর ভার্চুয়াল অবজেক্ট যোগ করে। সেই সাথে ইন্টারঅ্যাকশনের মাধ্যমে ব্যবহারকারী বাস্তব এবং ভার্চুয়াল উপাদানের সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে পারে।

 

উন্নত দেশগুলোতে ভার্চুয়াল ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির প্রচলন অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির ধারণাটি প্রথম উঠে আসে ১৯৬০ এর দশকে। ১৯৬৮ সালে ইভান সাদারল্যান্ড একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করেন, যাকে আধুনিক ভিআর হেডসেটের পূর্বসূরি বলা হয়। তারপর ১৯৮০-এর দশকে জ্যারন ল্যানিয়ের প্রথম ‘Virtual Reality’ শব্দটি প্রচলন করেন এবং ভিআর ডিভাইসের বিকাশ ঘটান। অন্যদিকে ১৯৯০সালে টম কডেল ‘Augmented Realiy’ শব্দটি প্রবর্তন করেন এবং ২০০০ এর দশকের দিকে এআর গেম এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন জনপ্রিয় হতে শুরু করে। উন্নত দেশে ভিআর প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হয় গেমিং, প্রশিক্ষণ (যেমন পাইলটদের সিমুলেশন), এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে।

 

তবে মজার বিষয় হলো এআর জনপ্রিয়তা পায় ২০১৬ সালে Pokémon GO গেমের মাধ্যমে। বর্তমানে সারাবিশ্বে ভিআর ও এআর-এর বিস্তৃত ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে বলা যায়। বিশেষ করে, গেমিং জগতে যেখানে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির মাধ্যমে উচ্চমানের ইমারসিভ গেম খেলা যায়। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে ভিআর ও এআর-এর ব্যবহার ব্যাপক। চিকিৎসা, ইঞ্জিনিয়ারিং, ও সামরিক ক্ষেত্রে সিমুলেশন প্রশিক্ষণে ভিআর ও এআর-এর উপযোগিতা প্রমাণিত। পাশাপাশি মেডিক্যালে সার্জারি প্র্যাকটিস এবং স্বাস্থ্যখাতে ভিআর ও এআর প্রযুক্তি ব্যাপক ব্যবহার করা হছে। সর্বপরি ব্যবসা ও বিপণন, বিনোদন জগত এবং স্থাপত্য ও ডিজাইনে ভার্চুয়াল ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির প্রচলনও শুরু হয়ে গেছে। তবে আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা শুধু মেডিক্যাল ও স্বাস্থ্যখাতে ভিআর ও এআর-এর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব।

 

মেডিক্যাল ও স্বাস্থ্যখাতে VR ও AR-এর ভূমিকা: মেডিক্যাল ও স্বাস্থ্যখাতে ভিআর এবং এআর প্রযুক্তি দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও শিক্ষার্থীরা উন্নত প্রশিক্ষণ এবং কার্যকরী চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারছেন। ভিআর এবং এআর প্রধানত নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।

 

মেডিক্যাল প্রশিক্ষণ: ভিআর এবং এআর ব্যবহার করে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা জটিল অপারেশন বা চিকিৎসা প্রক্রিয়া অভ্যাস করতে পারেন। ভিআর ব্যবহার করে চিকিৎসকেরা বাস্তব অভিজ্ঞতার মত একটি নিরাপদ ভার্চুয়াল পরিবেশে চিকিৎসা পদ্ধতি শিখতে পারেন, যা তাঁদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।

 

সার্জারি ও রোবোটিকস: এআর সার্জনদের অপারেশনের সময় নিখুঁতভাবে রোগীর শরীরের অভ্যন্তরীণ গঠন দেখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে, হৃদরোগ সার্জারি এবং নিউরোসার্জারিতে এআর-এর ব্যবহার উন্নত ফলাফল প্রদান করেছে।

 

 

থেরাপি এবং মানসিক চিকিৎসা: ভিআর ব্যবহার করে বিভিন্ন মানসিক রোগের চিকিৎসা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, উদ্বেগ, ফোবিয়া, চঞঝউ-এর ক্ষেত্রে ভিআর রোগীকে তার সমস্যার মুখোমুখি হতে সাহায্য করে। এই থেরাপির মাধ্যমে রোগী ধীরে ধীরে সমস্যার ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে পারেন।

 

রোগ নির্ণয় ও গবেষণা: ভিআর এবং এআর ব্যবহার করে চিকিৎসকরা দ্রুত এবং সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারেন। চিকিৎসকরা রোগীর শরীরের অভ্যন্তরীণ অবস্থা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে পারেন।

 

উন্নত দেশে স্বাস্থ্যখাতে ভিআর এবং এআর-এর ব্যবহার, সুবিধা ও প্রভাব: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং জাপানসহ উন্নত দেশে ভিআর এবং এআর ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে, যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল প্রশিক্ষণে ভিআর ব্যবহার করছে। কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

 

ভার্চুয়াল অপারেশন রুম: যুক্তরাষ্ট্রের মায়ো ক্লিনিক এবং ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা শিক্ষার্থীরা ভিআর-এর মাধ্যমে অপারেশন অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন। এতে তাঁদের বাস্তব জীবনেও অপারেশনের সময় ভুলের সম্ভাবনা কমে।

 

 

এআর-নির্ভর সার্জারি: যুক্তরাজ্যে এআর ব্যবহৃত হচ্ছে যাতে অপারেশন চলাকালীন সার্জন রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশের সঠিক অবস্থান জানতে পারেন। এটি চিকিৎসকদের জন্য রোগীর শরীরের গঠন এবং সমস্যাগুলি সরাসরি দেখতে এবং অপারেশন নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে সহায়ক।

 

মানসিক স্বাস্থ্য থেরাপি: ইউরোপে PTSD এবং ফোবিয়া থেরাপির জন্য ভিআর ব্যবহার করে সফল ফলাফল অর্জন করা হয়েছে। এই প্রযুক্তি রোগীদের উদ্বেগ কমাতে এবং তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তির উচ্চমূল্যের সত্ত্বেও সাশ্রয়: অতিরিক্ত খরচের পরও উন্নত দেশে ভিআর এবং এআর ব্যবহারে সরকারের বিশেষ সহায়তা এবং বেসরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে, ফলে খরচ সাশ্রয় ও সেবার মান উন্নত হয়েছে।

 

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভিআর এবং এআর-এর উপযোগিতা: বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রটি উন্নত করতে এবং সেবার মান উন্নত করতে ভিআর এবং এআর কার্যকর হতে পারে। দেশের দ্রুতগতিতে উন্নয়নশীল অর্থনীতি এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে এই প্রযুক্তিগুলোর প্রভাব অনেকদূর যেতে পারে।

১. মেডিক্যাল শিক্ষায় প্রশিক্ষণ: দেশের চিকিৎসা শিক্ষার্থীরা ভিআর-এর মাধ্যমে জটিল চিকিৎসা প্রক্রিয়া এবং অপারেশন অভ্যাস করতে পারবেন, যা তাঁদের দক্ষতা বাড়াতে সহায়ক হবে।

২. গ্রামীণ এলাকায় সেবা সম্প্রসারণ: ভিআর এবং এআর ব্যবহার করে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসাসেবা প্রদান সহজ করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা দূর থেকে গ্রামীণ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ দিতে পারবেন।

৩. মানসিক স্বাস্থ্য ও থেরাপি: বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য খাতে ভিআর এবং এআর ব্যবহার করে রোগীদের উদ্বেগ, PTSD, এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যা মোকাবেলায় সহায়ক থেরাপি প্রদান করা সম্ভব।

৪. রোগ নির্ণয়ে দ্রুততা: ভিআর এবং এআর ব্যবহার করে চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয় আরও দ্রুত এবং সঠিকভাবে করতে পারবেন, যা রোগীদের সময়মত চিকিৎসা প্রদান নিশ্চিত করবে। তবে বাংলাদেশের মতন উন্নয়নশীল দেশে ভিআর এবং এআর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন, প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অভাব: দেশের বেশিরভাগ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান উন্নত প্রযুক্তির অভাবে ভিআর এবং এআর ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে পারেনি।

 

উচ্চ খরচ: ভিআর এবং এআর সরঞ্জাম, প্রযুক্তি ব্যয়বহুল হওয়ায় দেশের বেশিরভাগ হাসপাতাল ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এটির খরচ বহন করতে পারে না।

 

সচেতনতার অভাব: ভিআর এবং এআর-এর সুবিধা সম্পর্কে এখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। রোগী ও চিকিৎসকদের এই প্রযুক্তির প্রতি আস্থা বাড়ানোর জন্য প্রচারণা প্রয়োজন। এইসব চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানের জন্য আমাদের সঠিক পন্থা, বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। এর মধ্যে রয়েছে, সরকারি সহায়তা ও তহবিল: সরকার ভিআর এবং এআর প্রযুক্তির অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ তহবিল বরাদ্দ করতে পারে এবং হাসপাতালগুলোকে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন করতে পারে।

 

যথাযথ প্রশিক্ষণ ও বিনিয়োগ: ভিআর এবং এআর সরঞ্জামগুলোর উচ্চখরচের কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। সচেতনতা ও প্রচারণা: ভিআর এবং এআর-এর সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, এনজিও, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একত্রে কাজ করতে পারে।

 

পরিশেষে এককথায় বলা যায়, ভার্চুয়াল এবং অগমেন্টেড রিয়্যালিটির সঠিক ব্যবহার বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লব আনতে পারে, যা দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে। উন্নত দেশগুলোর মতন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, চিকিৎসা শিক্ষার উন্নয়ন এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন করা সম্ভব। তবে এই প্রযুক্তিগুলির কার্যকরী প্রয়োগের জন্য সরকার, বেসরকারি খাত এবং জনগণের যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজন।

 

লেখক: প্রফেসর, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট