চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ জানুয়ারি, ২০২৫

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ হোক আমাদের পাথেয়

ড. মো. আবু তাহের

১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৪:১১ অপরাহ্ণ

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় এ ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীকে বুদ্ধিভিত্তিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়ে পরাজয়ের আগ মুহূর্তে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। এই সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে একেকজন দিকপাল। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিন্তক, গবেষক, সাহিত্যিক ও শিল্পীরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজে স্বীকৃত।

 

উইন্সটন চার্চিল কোন ঘটনা উপলব্ধি করে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটসহ জনসমক্ষে যারা তুলে ধরেন তাদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জোসেফ স্টালিন বুদ্ধিজীবীদের আত্মার কারিগর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বানাড মানার আসছিল আইনস্টাইন মানি বিগত মানবের উদ্বেগ প্রকাশনায় নিদর্শনে রাসেল ও আইনস্টাইন মানবিকতা ও মানবসভ্যতার সংকটে উদ্বেগ প্রকাশ এবং তা নিরসনে যারা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তাদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। বুদ্ধিজীবীরা কাজ করেন সার্বজনীন কল্যাণে, পরিচালিত হন অন্তরের তাগিদে। সরকার কিংবা সমাজপতি/রাজনীতিবিদদের ভয়ে কিংবা কোন প্রলোভনে তারা তাদের অন্তরের নির্দেশকে অমান্য করে কিছু করেন না।

 

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সক্রেটিস, এরিস্টটল, ডারউইন, প্লেটো, ভল্টেয়ার, মহাত্মা গান্ধী ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বুদ্ধিজীবী। তারা সমাজের অজ্ঞানতা, বিজ্ঞানবিমুখতা, স্বৈরাচারবিরোধিতা যেমন করেছেন তেমনি ফ্যাসিজম ও মানবিকতার বিরুদ্ধে নানা অপতৎপরতাকে রুখে দিয়েছেন দৃঢ় প্রত্যয়ে। অন্যান্য দেশের ন্যায় এত অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীরাও ঠিক একই প্রক্রিয়ায় জনগণের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নিয়ে পাকিস্তানিরা যখন ষড়যন্ত্র শুরু করেন তখনই ভাষাবিদ ড. শহিদুল্লাহ ১৯৫১ সালে বলেন, ‘পূর্ববাংলার জনগণের উপর উর্দুভাষা চাপিয়ে দিলে তা হবে গণহত্যার শামিল এবং প্রয়োজন হলে আমি একাই এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব।

 

তিনি আরো বলেন, আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য আমরা বাঙালি’।এই বক্তব্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন পাঞ্জাবি গভর্নর ফিরোজ খান নুন তাকে ‘Pandit you are a traitor’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ১৯৭১ সালে বিজয়ের উষালগ্নে বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ডাক্তার, সাংবাদিক যারা আমাদের আত্মার কারিগর ছিলেন, বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, তাদেরকে ধর্মান্ধ ও ফ্যাসিস্ট গোষ্টির দোসরদের জিগাংসার শিকার হতে হয়েছে। এটা সত্য যে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ সরলরৈখিক গতিতে চলেনি; আঁকাবাঁকা পথ ধরে, চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সামনে এগোতে হয়েছে।

 

জাতির যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে কিংবা সংকটে দেশের মানুষ বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে সত্য, ন্যায়ের পথের দিশা পাওয়ার প্রত্যাশা করে। যদিও এটা নিয়ে বর্তমানে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে, এতদসত্বেও প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা তাদের পূর্বসূরীদের ন্যায় অনেকেই লেখনীর মাধ্যমে সবসময় জনগণের পক্ষেই তাদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। সামাজিক অগ্রগতি ও মানবিকতার পক্ষে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল সবসময় সক্রিয়। শাসক, শোষক, নির্যাতক, অপশাসন এর বিরুদ্ধে এদের কলম অকুতোভয়। তারা জনগণের অভিব্যক্তিগুলো চিন্তাশীলতা ও লেখনীর মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। তারা যেমন ছিলেন সমাজসচেতন, মানবিক চৈতন্যভাস্বর তেমনি শোষণ-নির্যাতন অন্যায়-অত্যাচারসহ নানা অপতৎপরতা-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার।

 

একাত্তরে যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল তারা সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত না থাকলেও প্রধানত দুটো কারণে তাদের হত্যা করা হয়েছে : ১। তারা জাতীয়তাবাদ এর সাথে মনুষ্যত্বের সংযোগ গড়িয়ে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গড়ে তোলার সংগ্রামে তৎকালীন নেতৃত্বের সাথে একাত্ম হয়েছিলেন; ২। বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা-চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে, সে জন্য বিজয়ের উষালগ্নে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার অভিপ্রায়ে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের এইসব নির্মম হত্যার কথা মনে হলেই রোমের Desembrist Movement এর নেতা কবি রিলিয়েভির (Releeve) ও মহান মে বিপ্লবের নেতা Angust Spies ও Albert Persons এর কথা মনের পাতায় ভেসে ওঠে।

 

তাদের বক্তব্যের নির্যাস ছিল, আমাদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাতে পারো; কিন্তু ইতিহাসে আমাদের বক্তব্যেই বরাবরই প্রতিফলন ঘটবে। আজকের এই দিনে জাতির এই মহান সন্তানদের শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করি। মূলত বুদ্ধিজীবীরা তাদের জ্ঞান-মনীষা, লেখনির মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, অনুরনিত করেছেন। এই দিবসটি পালন তখনই সার্থক হবে, যদি আমরা তাদের উদার মানবিক চিন্তা ও গণতান্ত্রিক আদর্শকে ধারণ করতে পারি। তারা যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, উন্নত ও যুক্তিবাদী-আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই পথ ধরেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারি। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ হোক আগামীতে আমাদের পথ চলার পাথেয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বাংলার এই সূর্যের সন্তানদের স্মৃতি জাতি কোনদিন ভুলবে না। পরিশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তি ও মাগফেরাত কামনা করছি।

 

লেখক : প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ঢাকা।

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট