চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

ক্যাম্প পালানো রোহিঙ্গা পরিবারের বাসায় ঘটেছে সেই ডাকাতি

নাজিম মুহাম্মদ

৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যে চরম সংকট দেখা দিয়েছে সেই ভাবমূর্তি ফেরাতে গলদঘর্ম হচ্ছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এই ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যেই নগরীর কল্পলোক এলাকায় সদলবলে পুলিশ কর্মকর্তার ডাকাতির ঘটনা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

 

বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর কল্পলোক আবাসিক এলাকার এক বাসায় বাকলিয়া থানার এক এএসআই সদলবলে ডাকাতি করতে যান। ফেরার সময় ছাত্র জনতার হাতে পাঁচ সহযোগী হাতেনাতে ধরা পড়লেও লুট করা টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান ওই পুলিশ কর্মকর্তা। পরে পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে ফারুক মিয়া নামে ওই এএসআইকে গ্রেপ্তার করে বাকলিয়া থানা পুলিশ। ফারুক বাকলিয়া থানার চাকতাই ফাঁড়িতে কর্মরত ছিলেন।

 

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) রইছ উদ্দিন বলেন, গ্রেপ্তার ছয়জনকে ভবনের কেয়ারটেকার বাদী হয়ে করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাদের মধ্যে থাকা পুলিশ সদস্যকে ইতিমধ্যে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে ডিসি রইছ উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গা ওই দুই নারী কিভাবে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে বাসা ভাড়া নিল এটি আমরাও খতিয়ে দেখছি। ইতিমধ্যে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এই রোহিঙ্গাদের হেফাজতে নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

 

জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি-দক্ষিণ) শাকিলা সুলতানা জানান, সোহেল নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়েছে। তবে সোহেল কোন পত্রিকার সাংবাদিক তা জানাতে পারেনি ডিসি। নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) কাজী মো. তারেক আজিজ জানান, রোহিঙ্গাদের বাসায় ডাকাতি করে পালানোর সময় এক সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিসহ মোট পাঁচ জনকে আটকে পুলিশে দেয় স্থানীয়রা। আর এ ঘটনায় জড়িত পালিয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যকে বাকলিয়া থানা পুলিশই আটক করে।

 

যে ছকে ডাকাতির পরিকল্পনা: ক্যাম্প থেকে অবৈধভাবে পালিয়ে এসে নগরীর কল্পলোক আবাসিক এলাকায় বাসা ভাড়া নেন দুই রোহিঙ্গা নারী। সোহেল রানা নামে একজন সেই খবর পেয়ে চুপেচাপে সবকিছু লুটে নিতে ফন্দি এঁটে দলে ভেড়ান বাকলিয়া থানা পুলিশের এক উপ-পরিদর্শককেও। ওই পুলিশ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে দুই নারীর আলমারি ঘেঁটে স্বর্ণ ও নগদ অর্থ লুটে নেন। এ পর্যন্ত তাদের পরিকল্পনামতে চললেও ‘ভাগবাটোয়ারা’ পর্যন্ত যাওয়া যায়নি। ভবনের কেয়ারটেকার সবকিছু আঁচ করতে পেরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় পালিয়ে যাওয়ার সময় সোহেল রানাসহ পাঁচ জনকে হাতেনাতে আটক করেন। রোহিঙ্গা নারী ক্যাম্প থেকে অবৈধভাবে পালিয়ে এসেছে মূলত সেটিকেই টার্গেট করে তারা সবকিছু লুটে নেওয়ার এ পরিকল্পনা করেন।

 

সেদিন রাতে কী ঘটেছিল: গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে দশটার সময় নগরীর বাকলিয়া থানার কল্পলোক আবাসিক এলাকার নর্ম ভিলার কেয়ারটেকার আবদুল আজিজ বাদী হয়ে বাকলিয়া থানায় করা মামলায় নয়জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন, বাকলিয়া থানার চাকতাই ফাঁড়ির এ এস আই ফারুক মিয়া, পটিয়ার লাম্বুরহাটের মৃত মুক্তার আহমদের ছেলে জয়নাল আবেদীন (৩০), রাউজানের পাঁচখাইন ইউনিয়নের মৃত বশির আহমদের ছেলে মো. আকবর (৪১), বাঁশখালীর চাম্বল গ্রামের বদি আলমের ছেলে মিজানুর রহমান প্রকাশ মিজান (৩০), বাকলিয়া মাস্টারবাড়ির মৃত আবু তাহেরের ছেলে ফজলুল করিম (৩৮) ও লালখান বাজার এম আলী রোডের আবদুর রহিমের ছেলে সোহেল রানা। এছাড়া আরো তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন, বাকলিয়ার সৈয়দ শাহ রোডের মোজাফফরের ছেলে মোরশেদ (৪০), বাকলিয়া কালামিয়া বাজারের ফকির বাড়ির ওমান (৩৬) ও শাহিন (৪০)।

 

এজাহারভুক্ত নয়জন ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরো ৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে সোহেল রানা স্থানীয় একটি পত্রিকার সাংবাদিক বলে জানিয়েছে পুলিশ। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, উখিয়ার বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিবি জান (৩৫), রোকসানা (২৫), রোকসানার শ্বশুর লাল মিয়াসহ দুই মাস আগে বাকলিয়া কল্পলোক আবাসিক এলাকার নর্ম ভিলায় দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে পরিবারসহ বসবাস করছিল। গত বৃহস্পতিবার রাত দশটায় এ এস আই ফারুকসহ প্রায় ১৪/১৫ জন লোক এসে লাল মিয়াল ফ্ল্যাট কয় তলায় তা জানতে চায়। তারা নয় তলায় থাকে তা জানার পর এ এস আই ফারুক ও তার সহযোগীরা লিফটে নয় তলায় উঠে।

 

তাদের প্রায় সবার মুখে মাস্ক পরা ছিল। একজনের মাথায় হেলমেট ছিল। তারা রোহিঙ্গা লাল মিয়ার ফ্ল্যাটে ঢুকে নিজেদের পুলিশ ও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে লাল মিয়ার মেয়ে বিবি জান ও ছেলের বউ রোকসানার কাছ থেকে আলমারির চাবি নিয়ে নগদ ৩৬ হাজার টাকা, চার জোড়া কানের দুল, তিনটি আংটি, দুই জোড়া স্বর্ণের বালা, একটি লকেটসহ মোট আট ভরি ওজনের স্বর্ণালংকার লুট করে। এসব স্বর্ণালংকারের আনুমানিক বাজারমূল্য আট লাখ ৮০ হাজার টাকা। কেয়ার টেকার আবদুল আজিজ বলেন, ঘটনার সময় তিনি দরজার বাইরে অবস্থান করছিলেন। ফ্ল্যাটর ভিতর এএসআই ফারুকের সাথে যারা ছিলেন তাদের অনেকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিল। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে তারা টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে তারা বের হয়ে যায়। ফ্ল্যাট দুটিতে কোন খাটিয়া নেই। মেঝেতে বিছানা পাতা রয়েছে। আলমারি খোলা ও এলোমেলো অবস্থায় ছিল।

 

এ সময় লাল মিয়া টাকা ও স্বর্ণালংকার ফেরত চাইলে তারা পুলিশের ভয় দেখিয়ে হুমকি দেয়। তারা যখন ফ্ল্যাট থেকে নিচে নেমে গেট থেকে বের হয় তখন স্থানীয় লোকজন ও নিচে থাকা কিছু ছাত্র পাঁচজনকে আটক করে। এ সময় এএসআই ফারুকসহ বাকিরা পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন জানান, ডাকাতির খবর পেয়ে বাকলিয়া থানার ওসিসহ পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে জনতার হাতে আটক পাঁচজনকে থানায় নিয়ে যায়। তখনো এএসআই ফারুক ধরা পড়েনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার রাত দশটায় কল্পলোকে রোহিঙ্গার বাসায় ডাকাতির ঘটনার পর পাঁচজন ধরা পড়লেও এএসআই ফারুক লুট করা টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যথারীতি ফাঁড়িতে অবস্থান করছিল।

 

ডাকাতির ঘটনায় ফারুকের জড়িত থাকার বিষয়টি গোপন করতে চেষ্টা করেছিল থানা পুলিশ। বিষয়টি পুলিশ কমিশনারের কানে গেলে পরবর্তীতে পুলিশ কমিশনারের আদেশে ফাঁড়ি থেকে ডেকে শুক্রবার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট