চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৫৮ বছর পূর্ণ করে আজ ৫৯ বছরে পা দেবে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর হাটহাজারীর ফতেপুরের জোবরা গ্রামে পাহাড়ঘেরা ২ হাজার ৩শ’ একর সমতল ও উচুনিচু পাহাড়ি ভূমিতে আত্মপ্রকাশ করেছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের তৃতীয় এবং চারটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আয়তনের দিক দিয়ে এটি এখনো পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ ছাত্র-জনতার ৩৬ জুলাই অভ্যুত্থানসহ বাংলাদেশের যে কোনো জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্দোলন-সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশংসনীয় ভ‚মিকা আছে। দীর্ঘ ৫৮ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পদচারণা করেছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য জ্ঞানী ও গুণী, প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বরেণ্য মনীষীদের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে ক্যাম্পাস।
উপমহাদেশের খ্যাতিমান ভৌতবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম, শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ (বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবুল ফজল, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ আলী আহসান, মুর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুন, সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মান্নানসহ বহু কীর্তিমান মনীষী জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিদ্যাপীঠ জন্ম দিয়েছে অনেক গুণীজনের। তৈরি করেছে বিজ্ঞানী, বরেণ্য শিক্ষক, রাজনীতিক, সাংবাদিক, আইনবিদ, গবেষক, আমলাসহ অসংখ্য জ্ঞানী ও গুণীজন; যারা দেশে-বিদেশে নানাক্ষেত্রে অবিরাম অনন্য ভ‚মিকা রেখে চলেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে এটি আমার জন্য অহংকার ও গৌরবের, সন্দেহ নেই।
উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে সমুদ্রবন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সুপ্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রাম বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। এই জনপদে সারাবিশ্ব থেকেই আসা-যাওয়া করতো বড় বড় ব্যবসায়ী, ধর্মীয় পণ্ডিত এবং সন্ধিৎসু বিদগ্ধজন এবং বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজকগণ। চট্টগ্রাম শহরের পত্তনকালও ঢাকা এবং কোলকাতার শহরের অনেক আগের। এই শহরের বয়স ঢাকা-কোলকাতার চেয়ে অনেক বেশি। সমুদ্রপথে বহির্বিশ্বের প্রবেশদ্বার হওয়ায় এই জনপদের ভাষা-সংস্কৃতিও অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধ। সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামের ভাষা নানাবিচারেই উৎকৃষ্ট ভাষা। এ ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা বিচারে এটি পৃথিবীর ৬৯তম ভাষা। শিক্ষা-দীক্ষায়ও এই জনপদ এগিয়ে। তবে এ অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয় তুলনামূলকভাবে পরে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বিশ শতাব্দীর শুরুর দিকে চট্টগ্রাম বিভাগে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় চট্টগ্রামের অধিবাসীরা স্থানীয়ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অনুভব করে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর, কলকাতায় অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সর্বভারতীয় সম্মেলনে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সভাপতির ভাষণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’ প্রতিষ্ঠার কথা উপস্থাপন করেন এবং একই লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য ভূমি কিনেন। দুই বছর পর, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি নূর আহমদ চেয়ারম্যান বঙ্গীয় আইন পরিষদে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন। তবে নানাকারণে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
কিন্তু এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, যে আন্দোলন তিনি গড়ে তুলেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬০-১৯৬৫) প্রণয়নকালে চট্টগ্রামে একটি ‘বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণের স্থান হিসেবে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত চট্টগ্রাম সরকারি কলেজকে সম্ভাব্য ক্যাম্পাস হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনশিক্ষা উপপরিচালক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটি প্রাথমিক খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুর করা হয়।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম ওসমান গণিকে চেয়ারম্যান এবং ড. কুদরাত-এ-খুদা, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এম ফেরদৌস খান ও ড. মফিজউদ্দীন আহমদকে সদস্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্থান নির্বাচন কমিশন’ গঠিত হয়। এই কমিশন সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে হাটহাজারী উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের জঙ্গল পশ্চিমপট্টি মৌজার নির্জন পাহাড়ি ভূমিকে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হিসেবে সুপারিশ করে। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের প্রাক্তন কিউরেটর ড. আজিজুর রহমান মল্লিককে (এ আর মল্লিক) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প-পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
চট্টগ্রাম মহানগর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। ফলে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের যাতায়াত-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে মাস্টারপ্লানে শাটল ট্রেন অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। আর তা কার্যকর হয় ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে। এ শাটল ট্রেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আকর্ষণ। বর্তমানে বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার পথে পুরোটা সময়জুড়ে গানে গানে মুখর থাকে শাটলের সবকয়টি বগি। দিনের পর দিন বগি চাপড়িয়ে গানে গানে শাটল মাতিয়ে রাখেন শিক্ষার্থীরাই। রক-র্যাপের পাশাপাশি জারি-সারি, ভাটিয়ালি, প্যারোডি, পাহাড়ি ও বাংলা সিনেমার গানসহ এমন কোন গান হয়তো বাদ নেই, যা শাটলে গাওয়া হয় না। এ শাটলে বগি চাপড়িয়ে গান গেয়ে ইতোমধ্যে দেশবরেণ্য তারকার খেতাবও কুড়িয়েছেন অনেকেই। এর মধ্যে রয়েছেন কণ্ঠশিল্পী নকিব খান, পার্থ বড়ুয়া ও এস আই টুটুলের মতো দেশবরেণ্য শিল্পী।
বিভিন্ন রকম ছড়া, কবিতা, গান আর আড্ডায় মুখোরিত থাকে শাটল ট্রেন। শিক্ষার্থীদের আবেগের মিশেলে এটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গী হয়ে উঠেছে শুরু থেকেই। এই শাটল ট্রেনকে ঘিরে নানা সুখের ও কষ্টের স্মৃতি আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর। এ শাটল ট্রেনকে ঘিরে এখনো হাজারো শিক্ষার্থীর সুখ-দুঃখের গল্পগাথা আবর্তিত হয়। তবে শাটলযাত্রার তিনযুগে পৌঁছেও পুরোনো বগি ও ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইনের পরিবর্তন হয়নি। প্রতি বছর জ্যামিতিক হারে শিক্ষার্থী বাড়লেও বাড়েনি শাটলের শিডিউল। বরং লোকবলের সংকটে করোনা-পরবর্তী বন্ধ করে দেওয়া হয় নিয়মিত শিডিউলের ডেমু ট্রেন। ফলে প্রতিদিন প্রায় ১৪- ১৬ হাজার শিক্ষার্থীকে বাধ্য হয়েই গাদাগাদি করে শাটল ট্রেনে চলাচল করতে হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমানে শাটল ট্রেনে নিরাপত্তা নিয়েও আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা। ব্যাগ, মুঠোফোন চুরি, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ এখন নিত্যদিনের ঘটনা। এ বিষয়ে রেল ও চবি কর্তৃপক্ষের যুক্তিসঙ্গত উদ্যোগ দরকার।
আগের দিনগুলোতে চবির শিক্ষার মান নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা থাকলেও গত কয়েকবছরে মান ও গবেষণাকর্ম নিয়ে নানাধরনের প্রশ্ন উঠছে। শিক্ষাজীবন বিরক্তিকর দীর্ঘ করার অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে সেশনজট। বিভিন্ন সময় এই সেশনজট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া হলেও লেজুড়ভিত্তিক ও আদর্শহীন ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি, শিক্ষকদের দায়িত্বশীরতার অভাবসহ নানা কারণে তাতে সফলতা আসেনি। দেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠ হওয়া সত্ত্বেও চবিতে এখনো অনেক বিভাগ, অনুষদ ও ইনস্টিটিউটে রয়েছে ভয়াবহ সেশনজট। অথচ এ সেশনজট শিক্ষার্থীদের জন্য ভয়াবহ অভিশাপস্বরূপ। আবার দেশের উচ্চশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং চারটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হয়েও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র-টিএসসি। অথচ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে, মুক্তচিন্তার ধারাকে বিকশিত করতে, গবেষণায় এগিয়ে যেতে টিএসসি কার্যকর ভূমিকা রাখে।
সুনেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি হলেও প্রায় তিনযুগ ধরে চাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেই। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৮ বছরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন হয়েছে মাত্র ছয়বার। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠন চাকসু নির্বাচনের দাবি তুললেও প্রসাশনের সদিচ্ছার অভাবে নির্বাচন হয়নি বলে দাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের। তাদের দাবি ভিপি আর জিএসসহ পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি পদাধিকার বলে সিনেট মেম্বার। শিক্ষার্থীদের জন্য কষ্টসাধ্য কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তারা বাদ সাধতে পারেন। তাছাড়া সরকারের সদিচ্ছা না থাকলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে দাবি অনেকের। সে বিবেচনায় এখন যেহেতু ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন একটি অরাজনৈতিক সরকারই দেশ চালাচ্ছেন, সেহেতু দ্রুত চাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার; সুনেতৃত্ব সৃষ্টি ও শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি ও বাস্তবায়ন এবং ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে।
চবির ১৮তম উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতিও সব রেকর্ড ভঙ্গ করা অভিযোগ আছে। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, কেনাকাটা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সবকিছুতেই লাগামহীন দুর্নীতির অভিযোগ আছে। হলগুলো সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের দখলে থাকা এবং তাদের ইচ্ছে মতো সিটবাণিজ্য করার অভিযোগও আছে। ফলে তাদের কর্মী-সমর্থক ও অনুগ্রহভাজন ছাড়া সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা হলে থাকার সুযোগবঞ্চিত হতো। আবার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থও নাকি কর্তৃপক্ষ পেতো না। হলগুলোর খাবারের মান নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। এসব অভিযোগ সত্য হয়ে থাকলে খুবই দুঃখজনক। তদন্তসাপেক্ষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যাতে আগামির জন্য তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। সমাবর্তন অনুষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের কাছে এ অনুষ্ঠান অত্যন্ত আবেগের ও মর্যাদার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, দেশের এই শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়টির ৫৮ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়েছে মাত্র ৪টি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ২৮ বছর পর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম দায়িত্ব থাকাকালীন ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সমাবর্তন হয়। এরপর ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়, ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় এবং সর্বশেষ ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ সমাবর্তন। অথচ দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে আছে। এ বিষয়েও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে গবেষণা। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার সংখ্যা খুবই কম। বাজেটও নগন্য। আবার শিক্ষকরাও নাকি গবেষণার চেয়ে বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো এবং এনজিওসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্ট হিসেবে সময় দিতেই বেশি আগ্রহী। লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক-রাজনীতিও গবেষণাকর্মের প্রতি অনাগ্রহ তৈরি করছে। আবার বিজ্ঞজনদের অনেকেই মনে করেন চবির বিভিন্ন আইন ও শর্তও গবেষণাকর্মে, বিশেষত এমফিল এবং পিএইচডি গবেষণায় প্রতিবন্ধক হয়ে আছে।
এসএসসি থেকে শুরু করে অনার্স-মাস্টার্স পর্যন্ত সব পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি, একইসঙ্গে অনার্স মাস্টার্সে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ নাম্বার থাকার শর্তটি অনেক আগ্রহী মেধাবীকে গবেষণায় সম্পৃক্ত হওয়ার পথে বাধা হয়ে আছে। আমাদের জানা মতে, অনেক ছাত্র আছেন, যারা খুবই মেধাবী, কিন্তু অসুস্থতাজনিত বা অন্য কোনো কারণে পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ভালো ফল করতে পারেননি; কিন্তু পরবর্তীতে জ্ঞানচর্চায় নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাহলে কি তারা এমফিল বা পিএইচডি গবেষণাসহ বিভিন্ন গবেষণাকর্মে যুক্ত হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। এমন নিয়ম কোনো মতেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে রাষ্ট্র মেধাবীদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইয়াহ্ইয়া আখতার এবং উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন ও প্রফেসর ড. শামীম উদ্দিন খান খুবই বিজ্ঞ ও বিদগ্ধজন।
তাদের বিভিন্ন গবেষণাকর্ম পথনির্দেশনা হয়ে আছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলেছে। তাঁরা এখন চবি পরিচালনা করছেন। আমরা আশা করবো। তাঁরা এমফিল ও পিএইডি গবেষণার পথে অনার্স-মাস্টার্সে দ্বিতীয় শ্রেণিসহ ন্যূনতম ৫০ শতাংশ মার্কস থাকার শর্তসহ অযৌক্তিক ও অসঙ্গত শর্তের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করবেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জনের বলার মতো অনেক গল্প ও দৃষ্টান্ত আছে। তবে বর্তমান সময়ে কিছু বিষয় চবির এগিয়ে যাওয়ার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলেছে। এ সব বিষয়ের যুক্তিপূর্ণ সমাধান জরুরি। ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে’ আমরা প্রত্যাশা থাকবে বর্তমান প্রশাসন বাধাগুলো দূর করে চবি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যপূরণের পথ মসৃণ করে দেবেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে পঠন-পাঠন-গবেষণা সবদিক দিয়েই বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পরিণত করতে সবকিছুই করবেন।
লেখক : সাংবাদিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ২৫তম ব্যাচের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
পূর্বকোণ/ইব