বাংলাদেশের জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে দেশের একমাত্র তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারী লিমিটেডের (ইআরএল) দ্বিতীয় ইউনিট (ইআরএল-২) স্থাপনে বিদেশি অংশীদার খুঁজছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এজন্য সরকার ইতিমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও জাপানের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছে বলে জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
জ্বালানি বিভাগের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘সরকার জ্বালানি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ চাচ্ছে। তার অংশ হিসেবে ইআরএল-২ স্থাপনে বিদেশি পার্টনার খোঁজা হচ্ছে।’
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনে দেশের বেসরকারি খাতের আলোচিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। তবে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা (এমপি) যেমন আত্মগোপনে গেছেন, একইভাবে এস আলম গ্রুপের শীর্ষ ব্যক্তিরাও আত্মগোপনে।
এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যাংক দখল, অর্থ পাচার, ঋণ জালিয়াতি, নির্বাচনে টাকা খাটানোর মতো অনেক অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের জেরে গ্রুপটির অধীনে থাকা ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গত ২৯ আগস্ট জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ইস্টার্ন রিফাইনারী লিমিটেডের (ইআরএল) দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণের জন্য এস আলমের সঙ্গে হওয়া সরকারের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। এর পর থেকেই সরকার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নতুন অংশীদার খুঁজছে। সে লক্ষ্যে আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও জাপানের সংশ্লিষ্ট খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছে জ্বালানি বিভাগ।
চট্টগ্রামে ইস্টার্ন রিফাইনারী লিমিটেড অনুমোদন পায় ১৯৬০ সালে। প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায় ১৯৬৮ সালে। তৎকালীন সময়ে ইআরএলের ৩৫ শতাংশ মালিকানা ছিল ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন-এর (ইপিআইডিসি) হাতে, ৩৫ শতাংশ মালিকানা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্য সচিব ও আইসিএস কর্মকর্তা আব্বাস খলিলির নেতৃত্বাধীন বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে এবং বাকি ৩০ শতাংশ মালিকানা ছিল যুক্তরাজ্যের বার্মা অয়েল কোম্পানির হাতে।
বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ইআরএল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন-এর (বিপিসি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
এদিকে, ইস্টার্ন রিফাইনারীর দ্বিতীয় ইউনিট কীভাবে স্থাপন করা যায়, তা নির্ধারণে পরিদর্শন ও পরামর্শ বৈঠক করতে আজ শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) চট্টগ্রাম সফর করছেন জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
এ বিষয়ে ফাওজুল কবির বলেন, ‘ইআরএল-২ স্থাপনের বিষয়ে ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশের প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মেথডে বা জয়েন্ট ভেঞ্চারে (যৌথ উদ্যোগে) করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইআরএল-২ ইউনিট কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেটা নির্ধারণ করতে চট্টগ্রামে সরেজমিন পরিদর্শনে যাচ্ছি।’
জ্বালানি তেল আমদানি কমানোর জন্য ইআরএলের পরিশোধন সক্ষমতা বাড়াতে ২০১২ সাল থেকে ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসি ১৩ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে। আর বর্তমানে দেশের বার্ষিক জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬৫-৭০ লাখ টন।
ইআরএল বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধনে সক্ষম, যা দিয়ে দেশের চাহিদার সামান্যই মেটানো যায়।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতি বছরই একটু একটু করে জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট জ্বালানি তেলের ব্যবহার ৫৫ লাখ টনের বেশি ছিল।
ইআরএলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে পরিশোধন করতে পারলে কম খরচে পণ্যটি সরবরাহ করা যায়। কারণ, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে পরিশোধন করলে প্রতি লিটারে ১১ টাকা সাশ্রয় হয়।
সেই বিবেচনায় সরকার জ্বালানি তেলের সরবরাহ সক্ষমতা বাড়াতে ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগে নেয়। কাজটি একসময় সরকারি অর্থায়নে করার পরিকল্পনা ছিল। সে অনুযায়ী একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে বেশ আগে জমা দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন কারণে সেটি এগোয়নি।
২০২৩ সালের নভেম্বরে জ্বালানি বিভাগ বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপন, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিপূর্বক মজুত, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বিপনন নীতিমালা করে। এ নীতিমালা ঘোষণার পর গত জানুয়ারিতে ইস্টার্ন রিফাইনারীর সঙ্গে যৌথভাবে রিফাইনারি স্থাপনের আগ্রহ দেখিয়ে জ্বালানি বিভাগের কাছে প্রস্তাব দেয় এস আলম গ্রুপ। জ্বালানি বিভাগ প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদের সঙ্গে চুক্তি করে। কিন্তু বর্তমান সরকার সেটি বাতিল করেছে।
সূত্রমতে- ফ্রান্সের কোম্পানি টেকনিপ-কে দিয়ে ইতিমধ্যে ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের ডিজাইন তৈরি করা হয়েছে। ডিজাইন অনুযায়ী, প্রস্তাবিত রিফাইনারির বার্ষিক পরিশোধন সক্ষমতা হবে ৩০ লাখ টন। এই পরিশোধনাগারে কয়েক ধরনের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করার সুযোগ রাখা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।
সূত্র : টিবিএস
পূর্বকোণ/এএইচ