কাগজ ঘোষণা দিয়ে এক কোটি ৬২ লাখ পিস সিগারেটের নকল স্ট্যাম্প (ব্যান্ড রোল) আমদানি করেছিল নগরীর রামপুর আরাফাত এন্টারপাইজের মালিক আরাফাত হোসেন। ওই ঘটনায় ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বন্দর থানায় মামলা দায়ের করেন কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা এস এম জাকারিয়া।
মামলাটি দায়েরের পর তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় দুই বার। তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মেহেদী মাকসুদ ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চারজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। দীর্ঘ তদন্তে বিপুল পরিমাণ সিগারেটের নকল স্ট্যাম্প আমদানির নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারেনি। তিন বছরেও গ্রেপ্তার হয়নি আমদানির সাথে জড়িতরা। এ অবস্থায় ঘটনার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ দিয়েছেন পিবিআইকে।
তদন্তে অভিযুক্তরা হলেন, হালিশহরের রামপুর এলাকার কামাল হোসেনের ছেলে আরাফাত হোসেন (৪১), হালিশহরের শান্তিবাগের শ্যামলী আবাসিক এলাকার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের ছেলে বাহারুল ইসলাম, রামপুর বউ বাজার এলাকার নিজাম উদ্দিন হায়দারের ছেলে মেজবাহ উদ্দিন হায়দার ও মিরসরাইয়ের পূর্ব মিঠানালা গ্রামের আলতাফ আলীর ছেলে সরোয়ার আলী। এরমধ্যে বাহারুল গ্রেপ্তার হলেও বাকী তিনজনের হদিস মিলেনি। চীনের দিঘি এন্টি ফেইক কোং লি. থেকে এ ফোর পেপার ঘোষণায় এক কন্টেইনার কাগজ আমদানি করেন নগরীর জুবিলি রোডের কাদের টাওয়ারের আরাফাত এন্টারপ্রাইজের মালিক আরাফাত হোসেন।
মধুমতি এসোসিয়েটস লি. নামে একটি সিএন্ডএফ এজেন্টের ম্যাধমে পণ্যগুলো ছাড় কারানোর কথা ছিল। কাগজ ঘোষণা দিয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে আসা কন্টেইনারটি একই বছরের ২২ ডিসেম্বর শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষাকালে কন্টেইনারে থাকা ১২টি প্যাকেটর মধ্যে লুকানো অবস্থায় এক কোটি ৬২ লাখ পিস সিগারেটের নকল স্ট্যাম্প পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা এস এম জাকারিয়া বাদী হয়ে আরাফাত হোসেনকে প্রধান আসামি করে ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর নগরীর বন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আরাফাত এন্টারপ্রাইজের মালিক আরাফাত হোসেন এর আগেও কাগজ ঘোষণা দিয়ে আরো ছয়বার চীনের একই কোম্পানি থেকে একই কায়দায় পণ্য আমাদানি করেছে। ওই ছয়বারও আগ্রাবাদের মধুমতি এসোসিয়েটসহ লি. নামের একই সিএন্ডএফ এজেন্ট পণ্যগুলো ছাড় করেন। পেপার ঘোষণা দিয়ে কন্টেইনারভর্তি পণ্যগুলো আনা হলেও চীনের সেই রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে কাগজ উৎপাদনের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। নিয়ম অনুযায়ী সিগারেটের স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল দি সিকিউরিট প্রিন্টিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ হতে সংগ্রহ করতে হয়।
দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ এবং সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি প্রতি তিনমাস পর প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সিগারেটের স্ট্যাম্প এবং ব্যান্ডরোল সরবরাহ এবং ব্যবহার আড়াআড়িভাবে যাছাইপূর্বক প্রতিবেদন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মূসক বাস্তবায়ন শাখায় পাঠাতে হয়। এ জাতীয় পণ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস কর্পোরেশন ছাড়া অন্য কোথাও থেকে ক্রয় অথবা বিদেশ থেকে আমদানি করার সুযোগ নেই। মামলাটি ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তদন্তের দায়িত্বভার নেন সিআইডির পরিদর্শক মোজাহেদুল হাসান, এরপর ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট তদন্তের দায়িত্বভার নেন সিআইডির পরিদর্শক মুহাম্মদ শরীফ। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর চারজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমের পরিদর্শক মো. মেহেদী মাকসুদ।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর ছাড়াও একই ধরনের ঘোষণায় আরো ছয়বার চীনের একই রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানি করেছে। প্রত্যেকবার পণ্যগুলো কাস্টমস ও বন্দরে ছাড়করণের ক্ষেত্রে সহযোগী হিসাবে কাজ করেছে সিএন্ডএফ এজেন্ট মধুমতি এসোসিয়েটস লিমিটেড। মধুমতির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ বাহারুল ইসলামের আত্মীয় হলো কাস্টমস কাম জেটি সরকার সরোয়ার আলি। একই ধরনের পণ্য আমদানি করেছিল বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ নামে আরেকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। সবগুলো পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে কাজ করেছে মধুমতি এন্টারপ্রাইজ।
২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে বন্দর থানায় মামলা দায়ের করেন কাস্টমসের গোয়েন্দা শাখার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহরিয়ার হোসেন। ওই মামলায় মধুমতি এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাহারুল ইসলাম গ্রেপ্তার হয়ে ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবাবন্দি দিয়েছে। এতে তিনি বলেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আরাফাত এন্টারপ্রাইজের পরিচালনাসহ ব্যাংকিং কাজগুলো করতো হালিশহরের বউবাজার এলাকার মেজবাহ উদ্দিন হায়দার। মূলত আরাফাত এন্টারপ্রাইজের পক্ষে মেজবাহ ও আরাফাত দুইজনে মিলে ব্যাংক থেকে ইমপোর্ট করার কাগজপত্রের কাজগুলো করতো।
মধুমতির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাহারুল ইসলাম ও তার কর্মচারী সরোয়ার সিএন্ডএফ এজেন্ট হিসাবে শুল্কায়নের কাজ করতো। মেজবাহ, আরাফাত ও অজ্ঞাতানামা আরো কয়েকজন ব্যক্তি মিলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে চীন থেকে এ ফোর কাগজ ঘোষণা দিয়ে সিগারেটের জাল স্ট্যাম্প আনতো। আরাফাত কিংবা মেজবাহকে আটক করা গেলে মিথ্যা ঘোষণায় চীন থেকে থেকে আনা সিগারেটের স্ট্যাম্প অমদানি সিন্ডিকেটের পুরো তথ্য পাওয়া যেতো।
পূর্বকোণ/ইব