ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশে তেলজাতীয় ফসলের আবাদ বাড়ানোর বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে কৃষি অধিদপ্তর। এ লক্ষ্যে সরিষা, তিল, সূর্যমুখী ও চিনাবাদামের আবাদ বাড়ানোর লক্ষ্যে তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কৃষি অধিদপ্তর জানায়, ২০২৫ সালের মধ্যে ভোজ্যতেল আমদানি ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য এ বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৪-২০১৫ মৌসুমে চট্টগ্রামে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল মাত্র ৩৫১ হেক্টর জমি। ২০২২-২০২৩ সালে সরিষা আবাদ বাড়ানোর লক্ষ্যে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বিশেষ পরিকল্পনায় সরিষা ছাড়াও তেলজাতীয় ফসল তিল, সূর্যমুখী ও চিনাবাদামের আবাদ এবং উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদুচ ছোবহান পূর্বকোণকে বলেন, ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও পরিশ্রমে চট্টগ্রাম অঞ্চলের এখন সরিষাসহ তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন অনেক বেড়েছে।
অনেকেই নিজ ব্যবহার ছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে সরিষার চাষ করছেন। কৃষিবিদ আবদুচ ছোবহান বলেন, বোরো ও আমনের মাঝামাঝি সময়ে সরিষা আবাদ করা হয়। ধান ছাষ ছাড়াও সবজি চাষের সঙ্গে সরিষার চাষ করা হয়। চলতি মৌসুমে (২০২৩-২০২৪ সাল) চট্টগ্রামে সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমি। ২০১৫ সালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল মাত্র ৩৫১ হেক্টর জমি। ১০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৩ গুণ। তবে বিশেষ পরিকল্পনার পর গত তিন বছরে উৎপাদন প্রায় ৭ গুণ বেড়েছে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তারা। লাভ ভালো হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে সরিষা আবাদ বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। গত কয়েক বছরে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ফলে শস্যটির ফলনও আগের চেয়ে বেড়েছে।
বোয়ালখালীর কড়লডেঙ্গা ইউনিয়নে ৪-৫ বছর আগে সীমিত পরিসরে সরিষার চাষ শুরু হয়। সাথে মৌ-চাষও করা হয়। এতে বেশ সাড়া ফেলে। দেখাদেখিতে এখন উপজেলার চার ইউনিয়নে সরিষার চাষ করা হয়। বোয়ালখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ বলেন, আগে শুধু কড়লডেঙ্গা ইউনিয়নে সরিষা আবাদ করা হতো। সাথে মৌ-বক্স বসিয়ে মধ্য সংগ্রহ করা হতো। বর্তমানে উপজেলার কড়লডেঙ্গা, সারোয়াতলী, আমুচিয়া ও পোপাদিয়া এলাকায় সরিষার চাষ করা হচ্ছে। দাম ভালো পাওয়ায় চাষিদের মধ্যে সরিষা আবাদে আগ্রহ বাড়ছে।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ধান ও সবজির আবাদ হলেও সরিষার চাষ ছিল যৎসামান্য। কয়েক বছরে বিশেষ পরিকল্পনার ফলে আবাদ অনেক বড় হয়েছে। কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় উভয় জাতের সরিষা চাষ করছেন। দুই জাতের সরিষার নভেম্বরের শুরু বীজ ফেলা শুরু হয়। ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে ৯০ দিন পর্যন্ত। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, মৌমাছি সরিষার ফুলে বসে মধু সংগ্রহ করে। এতে সরিষা ফুলে সহজে পরাগায়ন ঘটে। তাই সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ চাষের বাক্স স্থাপন করলে সরিষার ফলন প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এতে একদিকে মধু আহরণ করে লাভবান হয় কৃষক, অন্যদিকে সরিষা চাষিরাও লাভবান হচ্ছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ তিন বছরে তেল আমদানির হার ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ হ্র্রাস করা যাবে। বাদাম ও সয়াবিনের তেল নিষ্কাশন সম্ভব হলে তেল জাতীয় ফসল থেকে ৪৮ দশমিক ২৯ শতাংশ আমদানি ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশে প্রতিবছর ২৪ লাখ টনের বেশি ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। যার প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। বাংলাদেশ বাণিজ্য ও ট্যারিফ কমিশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২২ লাখ টন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ লাখ টন আমদানি করা হয়েছে।
বিশ্বে সরিষা উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে কানাডা, গণচীন, নেপাল, নাইজেরিয়া, থাইল্যান্ড। তিল উৎপাদনে রয়েছে মিয়ানমার, ভারত, গণচীন, সুদান ও তানজানিয়া, চীনাবাদাম আমদানি করে গণচীন, ভারত ও নাইজেরিয়া। এসব দেশ থেকে সরিষাসহ তেলজাতীয় শস্য আমদানি করে বাংলাদেশ।
পূর্বকোণ/ইব