চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

অর্থনীতিসহ কয়েকটি বিষয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা প্রয়োজন

নাসের রহমান

২৭ অক্টোবর, ২০২৪ | ১:২৬ অপরাহ্ণ

বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কয়েকটি বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অর্থনীতির অন্যতম ব্যাংকিং খাত, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাব্যবস্থা। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব বিষয় বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। সবক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন কোন সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। কোথাও কোথাও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে যায়। যা অনেক সময় সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। দীর্ঘদিন যাবৎ বিশৃঙ্খলা চলতে থাকলে সেখানে নানা রকম অনিয়ম ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আইনশৃঙ্খলার ক্রম অবনতি ঘটতে থাকে। বিশৃঙ্খলাকারীরা মাথা ছাড়া দিয়ে ওঠে। বিশৃঙ্খলা একস্থান থেকে অন্যস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। একসময়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে। যে কোন স্থানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে কোন কিছু করা সম্ভব নয়। আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার।

 

স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করা খুবই প্রয়োজন। সবসময়ে যে কোন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলাকে সমুন্নত রাখা অপরিহার্য। যে কোনধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে সর্বাগ্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। যে কোন মূল্যে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য রোধ করতে হবে। এর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সময়পোযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করার গুরুত্ব সর্বাধিক। স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় না থাকলে উৎপাদনব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে উৎপাদন নানাভাবে ব্যহত হয়। আইনশৃঙ্খলাপরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে অন্যসব পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। এ জন্য সবার আগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করতে হবে আইনশৃঙ্খলার ওপর।

 

অর্থনীতির চাকা সবসময় সচল রাখতে হয়। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত ব্যাংকিংখাত। এ ব্যাংকিংখাত অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। সবাই কোন না কোনভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিধি অনেক বড়, ব্যাপক। আবার এসব কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যাংকের সাথে সম্পৃক্ত। ব্যাংক শুধু টাকা জমা রাখার স্থান নয়, বিনিয়োগেরও বড় মাধ্যম। ছোট-বড় মাঝারী নানাধরনের বিনিয়োগ ব্যাংকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাংক টাকা জমা বা আমানত রাখার স্থান হিসেবে বেশি পরিচিত। প্রত্যেকে মনে করে ব্যাংকে তার আমানত নিরাপদে থাকবে। যখন তার প্রয়োজন হবে তখন উঠিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু এ বিশ্বাসটা যখন অটুট থাকে না তখন হয়ে যায় আস্থার সংকট। এখন অনেক ব্যাংক এ আস্থার সংকটে পড়ে গেছে। তারা কোনভাবে গ্রাহকের আমানতের টাকা ফিরিয়ে দিতে পারছে না। কেউ একলাখ টাকা তুলতে চাইলে তাকে পঞ্চাশ হাজার আবার কেউ পঞ্চাশ হাজার তুলতে চাইলে তাকে বিশ-পঁচিশ হাজার দিয়ে মানাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু এতে অসন্তোষ বাড়ছে, সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে। অপরদিকে এসব ব্যাংক যেসব বিনিয়োগ করেছে তার অধিকাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিন যাবত তারুল্য সংকটে ভুগছে। কোন কোন ব্যাংক আমানতের চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে ফেলেছে। যার বড় একটি অংশ ফিরে না আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

সাধারণ আমানতকারীর কাছে এসব বিষয় বিবেচনার নয়। ব্যাংকিং নীতিমালা অনুযায়ী আমানতকারী যখনই জমাকৃত অর্থ ফেরৎ চাইবে তখনই ব্যাংক ফিরিয়ে দেবে এ শর্তে আমানত গ্রহণ করা হয়। আমানতকারী অর্থ ফেরৎ প্রদানের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের কোন সম্পর্ক নেই। আমানতকারী জমাকৃত অর্থ উত্তোলন করতে চাইলে ব্যাংক ফেরৎ দিতে বাধ্য। এক্ষেত্রে আমানতকারীর স্বার্থ সবার আগে সংরক্ষিত থাকে। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে এর ব্যর্তয় ঘটছে। অর্থাৎ আমানতকারী যথাসময়ে অর্থ ফেরৎ পাচ্ছে না। এতে করে পুরো ব্যাংকিং সেক্টর একধরনের অস্থিরতার মধ্যে পড়ে গিয়েছে। একদিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপীঋণের পরিমাণ আশংকাজনকভাবে বেড়ে গিয়েছে অপরদিকে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে চরম তারল্যসংকট চলছে। এ সংকট দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকলে ব্যাংকের অবস্থা আরো খারাপ হবে। একপর্যায়ে সাধারণ গ্রাহকের আস্থা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবে। এত অনেক ব্যাংক চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবে।

 

এটা অর্থনীতির জন্য কোনভাবে ইতিবাচক দিক নয়। গ্রাহকের আস্থা একবার বিনষ্ট হলে আর সহজে ফিরিয়ে আনা যায় না। এজন্য ব্যাংকগুলো ধ্বসে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। একইসাথে সংস্কারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে ব্যাংকিং সেক্টর আবার ঘুরে দাঁড়াবে। ব্যাংকের ওপর সাধারণ গ্রাহকের আস্থা পুনরায় ফিরে আসবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য স্থিতিশীল থাকা। সাধারণ মানুষের জন্য এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেশির ভাগ মানুষ নির্ধারিত আয়ের। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের এত বেশি তারতম্য ঘটে যা নির্ধারিত আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। তখন তাদের পরিমাণে কম কিনতে হয়। আবার কিছু সংখ্যক মানুষ আছে তারা কিনতেও পারে না। বাজার মনিটরিং বা ভোক্তা অধিকারের কথা বহুদিন থেকে শোনা যায়। কার্যত এসবের কোন সুফল সাধারণ ক্রেতার কাছে পৌঁছে না।

 

বাজারে জিনিসপত্রের সরবরাহ কম নেই, দেশজ উৎপন্ন কিংবা আমদানিকৃত পণ্য কোনটার কমতি দেখা যায় না। কিন্তু মূল্য এক বাজারে এক রকম। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে একই বাজারে মূল্যের ভিন্নতা দেখা যায়। এর বহুমুখী কারণ আছে। বাজার সিন্ডিকেট বাজার কারসাজি দ্রব্যমূল্যকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। তবে চাঁদাবাজিও আরেকটি কারণ। যা বর্তমানে থাকার কথা নয়। তাহলে দ্রব্যমূল্যে সে হারে কমলো না কেন? বরং অনেক ক্ষেত্রে আগের চেয়ে আরো বেড়ে গিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য বিশেষ উদ্যোগের প্রয়োজন। বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করে গড়ে তোলার প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার গুরুত্ব রয়েছে। কারণ মানুষ বহুদিন থেকে দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত। হঠাৎ করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। মানুষ সিন্ডিকেটের অবসান চায়। বাজার কারসাজি আর চায় না। স্থিতিশীল বাজার চায়। যেন দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে।

 

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। কিন্তু সাধারণ মানুষ কতটুকু স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকে। জেলা উপজেলায় হাসপাতাল গড়ে উঠলেও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে যা একেবারে অপ্রতুল। এসব কেন্দ্রে কতগুলো মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পায়? সেবার মানও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নয়। বেশির ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। নানাধরনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি। মানবসেবার ব্রত নিয়ে যারা আসে তারাও যেন বদলে যায়। অসহায় আর্তপীড়িত সাধারণ মানুষেরা স্বাস্থ্য সেবা পায় না এসব কেন্দ্রে। এর চেয়ে অমানবিক ও দুঃখজনক আর কি হতে পারে? হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বেড়েছে, নতুন যন্ত্রপাতিও এসেছে কিন্তু রোগী চিকিৎসা পায় না।

 

প্রাইভেট ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি হতে হয়। কয়জনের সামর্থ্য আছে প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা করার। সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। পদে পদে টাকা দিতে না পারলে চিকিৎসা পাওয়া যায় না। সেবা প্রদানকারীদের দৌরাত্বে রোগীরা অসহায় হয়ে পড়ে থাকে। কোথাও ডাক্তার নার্সের কমতি নেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া যায় না। মানুষ এসবের শেষ চায়, এ জঞ্জাল থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। স্বাস্থ্যসেবার নামে যে নৈরাজ্য তার থেকে পরিত্রাণ চায়। এজন্য স্বাস্থ্য সেবায় যারা নিয়োজিত তাদেরকে মানবকল্যাণের কথা ভাবতে হবে। কারণ স্বাস্থ্যসেবা মানবসেবার অন্যতম অংশ। স্বাস্থ্যসেবাকে বাদ দিয়ে মানবসেবায় বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া যায় না।

 

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন কাজ কর্ম করতে শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষিত লোক ছাড়া অফিস আদালত অচল। শিল্প কলকারখানায়ও শিক্ষিত জনবলের প্রয়োজন। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ মানব সম্পদে পরিণত হয়। জ্ঞান অর্জনের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন। কোন কিছু ঠিকমত বুঝার জন্যও শিক্ষার প্রয়োজন আছে। অথচ দীর্ঘ এত বছর পরও একটি সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। শিক্ষার মাঝেই সবচেয়ে বেশি গলদ। শিক্ষার হার বাড়লেও মান সম্মান শিক্ষা নেই বললে চলে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে। যেনতেনভাবে শিক্ষাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ না করে বার বার শিক্ষাক্রমকে পরিবর্তন করা হয়েছে। সংযোজন বিয়োজন পরিমার্জন করতে করতে শিক্ষার মূল্য উদ্দেশ্য ব্যহত হয়েছে।

 

শিক্ষার্থীরা নানাভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিভ্রান্তও হয়েছে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। শুধু শিক্ষাক্রম নয় শিক্ষাব্যবস্থায় নানারকম অনিয়ম ও দুর্নীতি আটঘাট বেঁধে রয়েছে। এর থেকে শিক্ষক শিক্ষার্থী কেউ মুক্ত নয়। এতে করে শিক্ষক শিক্ষার্থীর যে সম্পর্ক তার অবনতি ঘটেছে। শিক্ষকেরা শ্রেণীকক্ষের পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনের সান্নিধ্যে যাওয়ার যে প্রবণতা তা হারিয়ে গিয়েছে। শিক্ষকদের সমীহ করার ব্যাপারটি এখন আগের মত নেই। আবার শিক্ষকরাও ছাত্র-ছাত্রীদের আপন করে নিতে পারে না। এখানে এক ধরণের দূরত্ব বিরাজ করে।

 

শিক্ষক ছাত্রদের মাঝে আন্তরিক পরিবেশ নেই। এভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে চলতে দেওয়া যায় না। এর থেকে যে কোনভাবে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। যুগপোযোগি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক পুন:প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে তৈরি করতে হলে তাদের শিক্ষা বা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে গড়ে তুলতে হবে। এ আলোকিত শিক্ষার্থীরা একদিন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিবে।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকনির্বাহী।

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট