চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

কানাডা-ভারত সম্পর্কে চরম টানাপোড়েন

কাজী আবুল মনসুর

২০ অক্টোবর, ২০২৪ | ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ

সময়টা ভালো যাচ্ছে না কানাডায় থাকা ভারতীয়দের। দু’দেশের মধ্যে ক‚টনৈতিক সর্ম্পকের ব্যাপক টানাপোড়েন চলছে। উভয় দেশ জড়িয়ে গেছে পাল্টাপাল্টি বির্তকে। উভয় দেশ তাদের কূটনৈতিক বহিস্কারের মাধ্যমে জানান দিচ্ছে কেউ কারও চেয়ে কম না। এ টানাপোড়েনে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত কানাডা পড়তে যাওয়া ৩ লাখ ছাত্র-ছাত্রী। বসবাসরত প্রায় লাখ ভারতীয় সঙ্কট নিরসনের দিকে তাকিয়ে আছে।

 

ভারত এবং কানাডার মধ্যে বর্তমানে ক‚টনৈতিক উত্তেজনার মূলে রয়েছে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। কানাডাতে শিখদের বেশ প্রভাব রয়েছে। গত ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা। কানাডা প্রথমে একজন ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। কানাডার অভিযোগ ওই ক‚টনীতিক ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর অন্যতম ব্যাক্তি। কানাডার কূটনীতিক বহিষ্কারের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতও কানাডার একজন সিনিয়র কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। ভারত এই পদক্ষেপকে ‘পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করে। তবে এসব কিছুর নেপথ্যে রয়েছে খালিস্তানি হরদীপ সিং নিজ্জর নামের এক ব্যাক্তির খুন হওয়ার ঘটনা। গত ২০২৩ সালের শেষের দিকে কানাডায় খুন হন হরদীপ সিং নিজ্জর নামের এক খালিস্তানি শিখ। এ ঘটনার পেছনে ভারতের হাত রয়েছে বলে সে সময় উল্লেখ করে কানাডার জাস্টিন ট্রুডো সরকার। ভারত এর প্রতিবাদ জানায়। কিন্ত কানাডা দৃঢ়ভাবে বলে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এ কাজ করেছে। এর পরই ভারত-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে যেতে শুরু করে। এর মধ্যে আগুনে ঘি ঢালার মতোন কাজ করে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে কানাডায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনারকেই নিজ্জর খুনে ‘সন্দেহভাজন’ তালিকায় রয়েছে বলে দাবি করেছে জাস্টিন ট্রুডো প্রশাসন। কানাডা পুলিসের অভিযোগ, কুখ্যাত গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংকে কাজে লাগিয়েছে ভারত।

 

গোটা পরিকল্পনায় জড়িত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। বিজেপি নেতা অমিত শাহের নির্দেশেই সবকিছু হয়েছে বলে পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়। রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিসের (আরসিএমপি) অফিসারদের কথা উল্লেখ করে গত সোমবার এই বিস্ফোরক দাবি করে বিখ্যাত মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’। এরপরই উভয় দেশের মধ্যে টানাপোড়েন আরও চরম আকার ধারণ করে। কানাডার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তোলপাড় শুরু হয়। ভারত সরকার বার বার যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করলেও ওয়াসিংটন পোস্টের প্রতিবেদন ভার কে নতুন করে টেনশনে ফেলে দেয়। ভারতীয় গণমাধ্যম বর্তমান সূত্রে জানা যায়, গত সোমবার কানাডায় সাংবাদিক সম্মেলনে আরসিএমপি ডেপুটি কমিশনার ব্রিজিট গভিন দাবি করেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সঙ্গে ভারত সরকারের এজেন্টদের যোগ রয়েছে। দক্ষিণ এশীয় নাগরিকদের পাশাপাশি মূলত খালিস্তানপন্থীদের আক্রমণ করা হচ্ছে।’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১২ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে গোপন বৈঠকে বসেছিলেন কানাডার গোয়েন্দা সংস্থা ও বিদেশ মন্ত্রকের পদস্থ আধিকারিকরা। সেখানে ট্রুডোর দেশ এই অভিযোগ তুলে জানায়, এ সংক্রান্ত একাধিক তথ্যপ্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। তারপর গত রবিবার আঙুল তোলা হয় ভারতীয় হাই কমিশনার সঞ্জয় কুমার ভার্মার দিকে। তাতেই তরজা সপ্তমে ওঠে।

 

ট্রুডোর দেশকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করে নয়াদিল্লি। নিরাপত্তার কারণে সঞ্জয় সহ একাধিক কূটনীতিককে দেশে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একইসঙ্গে বরখাস্ত করা হয় ভারতে নিযুক্ত কানাডার কার্যনির্বাহী হাই কমিশনার স্টুয়ার্ট উইলার সহ সে দেশের ছয় কূটনীতিককে। অনুসন্ধান বলছে, কানাডায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিখ জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মধ্যে কেউ কেউ খালিস্তান আন্দোলনের সরব সমর্থক। ভারত সরকার কানাডায় শিখ প্রবাাসীদের মধ্যে প্রকাশ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবধারার বরাবরই বিপক্ষে। মাঝে মাঝে এসব নিয়ে ভারত উদ্বেগও প্রকাশ করে। কানাডায় বিভিন্ন সময়ে খালিস্তানপন্থীদের সমর্থনে নানা সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় । কানাডা সরকার যদিও এই বিষয়ে মুক্ত মতপ্রকাশের পক্ষে অবস্থান নেয়। কানাডা বলছে, যতক্ষণ নাগরিকদের রাজনৈতিক মতামত আইনসঙ্গত থাকে, ততক্ষণ তারা এ ধরনের মতামত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এর মধ্যে ২০২৩ সালে হারদীপ সিং নিজ্জার খুন হলে ভারতকে এর সাথে জড়িত বলে উল্লেখ করে কানাডা। নিজ্জার কানাডিয়ান শিখ প্রবাসীদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট খালিস্তানপন্থী নেতা ছিলেন। কিন্ত ভারত তাকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত করে।

 

এরপরই দু’দেশের মধ্যে ক‚টনীতিক বহিস্কারের মাধ্যমে সর্ম্পকে ফাটঁল ধরতে থাকে। ভারত কানাডিয়ান নাগরিকদের জন্য ভিসা পরিষেবা স্থগিত করে। একই সাথে কানাডায় ভ্রমণের সময় তাদের নাগরিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়। ভারত জানায়, কানাডায় ভারতবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে। ভারত কানাডার কূটনীতিক সংখ্যা কমানোর দাবি জানায়, কারণ ভারতের যুক্তি ছিল কানাডায় যে পরিমান কূটনীতিক রয়েছে তার তুলনায় ভারতে কানাডিয়ান কূটনীতিকের সংখ্য অনেক বেশি। কানাডা এই দাবি মেনে নিলেও, এটি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও সংকটাপন্ন করে তোলে। এর মধ্যে প্রভাব পড়েছে বাণিজ্য আলোচনা, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক সর্ম্পকের ক্ষেত্রেও। জাস্টিন ট্রুডো সরকার এ হত্যাকান্ডে তদন্তে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে। কার্যত উভয় দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন না করলেও, পরিস্থিতি এখনও সংকটাপন্ন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয় দশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। অনেক দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত গুরুত্বের কারণে ভারত ও কানাডার সর্ম্পক স্বাভাবিক করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে। তাছাড়া ভারত ও কানাডার মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বিশেষ করে বাণিজ্য, শিক্ষা এবং অভিবাসন খাতে যোগাযোগ অনেক দিনের পুরানো। কানাডায় উল্লেখযোগ্য ভারতীয় সম্প্রদায় বসবাস করে।

 

২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, প্রায় ১৯ লাখ (১.৯ মিলিয়ন) ভারতীয় বংশোদ্ভূত লোক কানাডায় বসবাস করে, যা কানাডার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ দশমিক ১ শতাংশ। এই ভারতীয় প্রবাাসীরা কানাডার অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষার্থী, পেশাজীবী এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে জড়িত। কানাডায় প্রতি বছর ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, কানাডায় প্রায় ৩ লাখ এরও বেশি ভারতীয় শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। ভারতীয় শিক্ষার্থীরা কানাডায় উচ্চশিক্ষার জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়। কারণ দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থা, গবেষণার সুযোগ এবং স্থায়ী বসবাসের সুবিধাগুলো তাদের আকৃষ্ট করে। কানাডা ও ভারতের মধ্যে চলমান কূটনৈতিক সঙ্কটের ফলে ভারতীয়রা বিশেষভাবে চিন্তিত। ভারত ইতোমধ্যে কানাডার জন্য ভিসা পরিষেবা স্থগিত করেছে। এর ফলে যারা কানাডায় পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক, তাদের জন্য ভিসা প্রসেসিংয়ের সময় দীর্ঘ সূত্রতায় পড়বে। নতুন ভিসার জন্য জটিলতা দেখা দেবে। আবার যারা পড়াশোনা করছে, তারা যদি কোনো কূটনৈতিক জটিলতায় পড়ে বা ভারত-কানাডার সম্পর্ক আরও খারাপ হয়, তাহলে তাদের ভবিষ্যতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সমস্যা হতে পারে।

 

কানাডায় পড়াশোনা শেষ করার পর অভিবাসনের সুযোগও সীমিত হতে পারে। এছাড়া ভারতীয়দের জন্য ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়তে পারে। ভ্রমণের সুযোগ সীমিত হতে পারে। ভারতীয় নাগরিকদের কানাডা ভ্রমণ বা ব্যবসায়িক ভ্রমণের পরিকল্পনাও বাধাগ্রস্ত হবে। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি উভয় দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কানাডা ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর ফলে দু’দেশের কোম্পানিগুলোর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। একদিকে ভারতীয় কোম্পানীগুলো কানাডায় বিনিয়োগ কমিয়ে দিতে পারে. অন্যদিকে কানাডার কোম্পানিগুলোও ভারত থেকে দূরে থাকতে পারে।

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট