দুয়ারে কড়া নাড়ছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। আগামী ৫ নভেম্বর মার্কিন নাগরিকরা চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে ভোট দেবেন। এবারের নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবারের নির্বাচনে প্রধান্য পাচ্ছে অভিবাসন নীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু ও অর্থনৈতিক মন্দা। এরমধ্যে ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বাজছে। মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলার কথা বললেও এখনও আক্রমণ চালায়নি। আক্রান্ত হলে ইরানও পাল্টা হামলার হুমকি দিয়ে রেখেছে। এবারের হিসাবটা জটিল।
রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের আক্রান্ত কয়েকটি দেশ ইরানের পাশে রয়েছে। যুদ্ধ বেঁধে গেলে দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারে। তাছাড়া ইসরায়েলকে হামাস, হিজবুল্লাহ, ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স, হুতিসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তাই মিত্রদের নিয়ে ইরানে হামলার ছক কষছে ইসরায়েল। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে বাইডেন প্রশাসন আপাতত ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। মার্কিন প্রশাসনের শঙ্কা রয়েছে যে, এ সংঘাত আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এদিকে, গাজা ও লেবাননে নির্বিচার বিমান ও স্থল হামলা অব্যাহত রেখেছে। গত একবছরে গাজায় প্রাণ গেছে ৪২ হাজারের অধিক মানুষের, যার অধিকাংশ নারী পুরুষ। আর লেবাননে প্রাণ গেছে ১২শরও অধিক। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের এই বিস্ফোরোণ্মুখ পরিস্থিতি মার্কিন নির্বাচনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ভেতরে বাইরে চাপের মুখে পড়েছে বাইডেন প্রশাসন। তবে ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্ষমতার পালাবদল চলতে থাকলেও ডেমোক্র্যাটস ও রিপাবলিকানদের সবসময় একটি ইস্যুতে এক থাকতে দেখা গেছে। সেটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা। দুই দলের নেতারা সবসময় এই মনোভাব দেখিয়ে এসেছেন যে, ইসরায়েলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র নেই ও ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়টি সবসময় আলোচনার ঊর্ধ্বে।
বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে বছরের পর বছর ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচার গণহত্যাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। অজুহাত একটাই, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের হিসাব বলছে, ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়েছে, যার বেশিরভাগই সামরিক সহায়তা। এই সংখ্যা মার্কিন সহায়তা পাওয়া দেশের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা মিশরের প্রায় দ্বিগুন। যদিও মিসরের জনসংখ্যা ১১১ মিলিয়ন, আর ইসরায়েলের সাড়ে ৯ মিলিয়ন। ২০২০ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ৩.৮ বিলিয়ন (৩৮০ কোটি) ডলার সাহায্য দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনামলে ইসরায়েলকে দীর্ঘমেয়াদী যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার অধীনেই এই সাহায্য গেছে। প্রায় পুরোটাই ছিল সামরিক সাহায্য। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার নেপথ্যে কাজ করে প্রভাবশালী ইসরায়েলি লবি, তাদের অর্থ এবং মার্কিন রাজনীতিতে তাদের প্রভাব। যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার তিন শতাংশ ইহুদি হলেও দেশটিতে তাদের লবি অত্যন্ত শক্তিশালী। দেশটির বড় বড় কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইহুদিদের শক্ত অবস্থান রয়েছে।
এ ছাড়া সংবাদমাধ্যমেও তাঁদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে বড় অঙ্কের অনুদান দিয়ে থাকেন ইহুদি ধনকুবের ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে নির্বাচনে সিংহভাগ প্রো-ইসরায়েল প্রার্থী জয়লাভ করে। আমেরিকার রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে মূলত কর্পোরেট হাউজগুলো। তারা প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বানাতে পারে, সরাতে পারে। এসব কর্পোরেট হাউজগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় এদের মালিক কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলোর মূল দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও হলেন জুইশ কমিউনিটির মানুষ। এটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকদের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন আদায়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক সংগঠন কাজ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হলো আইপ্যাক (American Israel Public Affairs Commitee)। এদের পাঁচ মিলিয়নের বেশি সদস্য রয়েছে। এই সংস্থাটি আমেরিকায় বেশির ভাগ ইহুদি সংগঠন বা সংস্থার তৎপরতায় সমন্বয় সাধনের কাজ করে এবং পরিকল্পনা প্রণয়নেও জড়িত।
মার্কিন নীতিগুলোকে ইহুদিবাদী স্বার্থের সঙ্গে সমন্বিত করতে প্রধান ভূমিকা রাখে এই আইপ্যাক। এসব কাজের জন্যই আইপ্যাক গড়ে তুলেছে বহু সংগঠন। এক্ষেত্রে ধর্মীয় ও জাতিগত বন্ধনগুলোকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হয়, যাতে মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী কাঠামোগুলোতে প্রভাব রাখা সহজ হয় এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক যন্ত্রকে এসব লক্ষ্যের দিকে পরিচালনা করা যায়। আইপ্যাকের এসব গুরুত্বপূর্ণ কৌশল বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হয় অর্থনৈতিক ও প্রচারণার ব্যাপক শক্তি-সামর্থ্য। মার্কিন কংগ্রেস ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সেইসব প্রার্থীকে আইপ্যাক এসব শক্তি দিয়ে সহায়তা করে, যেসব প্রার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি আইপ্যাকের দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি বা আইপ্যাকের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অভিন্ন। কংগ্রেসে আইপ্যাকের এমন প্রভাব ও ক্ষমতার কারণেই ইসরাইল সেখানে সব ধরনের প্রতিবাদ বা সমালোচনা থেকে মুক্ত। কংগ্রেসে বিতর্কিত সব বিষয়ে আলোচনার সুযোগ থাকলেও ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় সামনে এলে সম্ভাব্য প্রতিবাদকারীরা সাধারণত নিরব হয়ে যান এবং খুব কমই এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। আইপাকের এমন অসাধারণ ক্ষমতা ও সাফল্যর কারণ হলো, সংস্থাটি তার কর্মসূচির পক্ষের আইন-প্রণেতা ও কংগ্রেসের প্রার্থীদের পুরস্কার দিতে ও বিপক্ষকে শাস্তি দিতে সক্ষম। অন্যদিকে মার্কিন নির্বাহী বিভাগে আইপ্যাকের প্রভাবের উৎস হলো, অনেকাংশেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জড়িত ইহুদি ভোটাররা। ইহুদিদের সংখ্যা যদিও খুব কম, তা সত্তে¡ও তারা মার্কিন নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বি দুই দলকেই বিপুল অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে।
‘কংগ্রেশনাল ক্লাব’ নামে আইপ্যাকের বিশেষ একটি দল আছে। এই দলের প্রত্যেক সদস্য প্রতি নির্বাচনে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার ডলার চাঁদা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এই অর্থ ইজরায়েলপন্থী রাজনীতিবিদদের নির্বাচনে ব্যয় করা হয়। তবে তাদের এমন কিছু সদস্য আছে, যারা এক মিলিয়ন থেকে শত মিলিয়ন পর্যন্ত অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। আর এই সকল দাতাদের ধ্যান-ধারণা সবই ইজরায়েলকে ঘিরে। তারা যেকোনো মূল্যে মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলকে টিকিয়ে রাখতে তাদের পছন্দসই প্রার্থীকে বিজয়ী করতে চান। পরবর্তীতে এদের মধ্যে যারা নির্বাচনে জয়লাভ করে, তাদের মাধ্যমে সিনেট এবং হাউজে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের নীতির বাস্তবায়ন করে। শুধুমাত্র ট্রাম্পের শাসনামলেই আইপ্যাক অনেকগুলো সফলতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী ঘোষণা, ইরানের সাথে করা পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে আসা এবং ফিলিস্তিনকে দেওয়া সাহায্য বন্ধ করা। এই আইপ্যাকের প্রভাব এতই গভীর ও শক্তিশালী যে, মার্কিন কর্মকর্তারা অনিচ্ছা সত্তে¡ও ইসরাইলি নীতির সঙ্গে তাল মেলাতে বাধ্য হন। আর এর অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টরা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও আইপ্যাকের চাপ ও প্রচারণার ধূম্রজালের প্রভাবে ওই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। সংগঠনটি প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বার্ষিক সম্মেলন করে থাকে। এতে প্রায় ২০ হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন, যাঁদের মধ্যে মার্কিন রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন, এমন ব্যক্তিদেরও দেখা যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিয়মিত এই সম্মেলনে হাজির হয়ে থাকেন। আইপ্যাক অনেকটা রিপাবলিকানপন্থী হওয়ায় ইহুদি লবিকে হাতে রাখতে ‘জি স্ট্রিট’ নামের ছোট একটি ইসরায়েলপন্থী সংগঠন গড়ে তুলেছেন ডেমোক্র্যাটরা। এদের লক্ষ্য, মার্কিন রাজনীতিতে একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করা, যারা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি সোচ্চার হবে। ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে, তাই ক্ষমতা ধরে রাখতে আমেরিকাকে অবশ্যই ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে। ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ছাড়াও এই সমর্থনের আরও একটি কারণ ধর্মীয়। ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টান সম্প্রদায় হলো আমেরিকার সবচেয়ে বড় একক ধর্মীয় গোষ্ঠী, যারা আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ, মূলত দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে তারা বাস করে। ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক হওয়ার কারণ হিসেবে তারা মনে করে ইহুদিরা জেরুজালেমে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে যিশুখ্রিস্টের পুনরাগমন হবে না। তারা মনে করে যীশু খ্রীষ্ট পুনরায় পৃথিবীতে এসে আরমাগেডনের যুদ্ধে শয়তানকে (খ্রিস্টারি, দাজ্জাল) পরাজিত করবে ও ইহুদিরা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করবে। এরপর এক হাজার বছর পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করবে। এই বিশ্বাসের কারণে ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানেরা সবসময়ই ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনের কট্টর সমর্থক।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে সম্প্রতি নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ হয়েছে। কিছু আমেরিকান আইনপ্রণেতা ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেছেন। বার্নি স্যান্ডার্সের মত রাজনীতিবদ ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তার দাবি জানিয়েছেন। সাম্প্রতিক জরিপে, যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের মধ্যে ইসরায়েলের সমর্থন কমেছে। এরপরও নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি খুব একটা পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে তো নয়ই, মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক
পূর্বকোণ/ইব