চট্টগ্রাম শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

নৌ বাণিজ্য ও পেশাদারিত্ব

ক্যাপ্টেন ফয়সাল আজিম

১৪ অক্টোবর, ২০২৪ | ৬:৫৩ অপরাহ্ণ

নৌ বাণিজ্য একটি সম্পূর্ণ পেশাদারী ব্যবসা – এই ব্যবসা এই বিষয়ে সমূহ-জ্ঞান থাকা পেশাদার ব্যক্তিদের মাধ্যমে পরিচালনা করা আবশ্যক। অনেক সময়, অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাও এই ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যান। অথচ, অনভিজ্ঞ, অপেশাদার ব্যক্তিদের দিয়ে পরিচালনার ফলে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ৫০ বছর পার হলে ও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেনা। পেশাদার ও অপেশাদার ব্যক্তিদের হাতে থাকার ফলাফল কি হয়, উদাহরণ হিসাবে বি এস সি (bsc.portal.gov.bd) এবং একটি বিদেশী জাহাজ কোম্পানি হংকং ভিত্তিক শিপিং কোম্পানি ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড (www.fleetship.com) এর দিকে নজর দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) এবং ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড (এফএমএল)-এর মধ্যে মূল পার্থক্যটা হচ্ছে, তাদের প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে পেশাদার ব্যক্তিদের মাধ্যমে আর বি এস সি অপেশাদার ব্যক্তি দ্বারা। নৌ বাণিজ্যে উন্নতি করতে হলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নৌ বাণিজ্যের অভিজ্ঞতার গুরুত্ব যে কতটা, তা এই প্রতিষ্ঠান দুইটি দিকে তাকালে সহজে বুঝা যাবে।
২৯ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এফএমএল পেশাদার নেতৃত্ব এবং বাণিজ্যিক শিপিং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত। বর্তমানে এফএমএল ৬৫০টিরও বেশি জাহাজ পরিচালনা করে এবং ১২টি দেশে ২৭টি অফিস পরিচালনা করে, যা তাদের ব্যবসার বিস্তৃতি ও পেশাদারিত্বকে প্রতিফলিত করে।
বিপরীতে, বিএসসি অলাভজনক ও রুগ্ন প্রতিষ্ঠান। ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত বিএসসি-এর বহরে বর্তমানে চালু অবস্থায় রয়েছে মাত্র পাঁচটি জাহাজ, অব্যবস্থাপনার কারণে সম্প্রতি তিনটি জাহাজ হারিয়েছে। বেশির ভাগ সময় বিএসসি-এর নেতৃত্ব নৌ বাহিনীর অফিসার বা আমলাদের হাতে থাকার কারণে তারা বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়েছে। অনভিজ্ঞতা বিএসসি-কে একটি স্থবির অবস্থায় ফেলে দিয়েছে, যেখানে এফএমএল-এর মতো কোম্পানিগুলি বৈশ্বিক পর্যায়ে তাদের অবস্থান আরও দৃঢ় করে চলেছে। তারা শিপিং শিল্পের নিয়মকানুন, লজিস্টিক্স, গ্রাহক সম্পর্ক এবং নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোর গুরুত্ব বোঝেন এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত কোম্পানিকে শুধু লাভজনকতা অর্জনেই সহায়তা করে না, বরং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ও টেকসই বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। এই কোম্পানির মূল দায়িত্বে আছেন একজন ক্যাপ্টেন।
অন্যদিকে, বিএসসি-এর নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের শিপিং ব্যবসার অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। অনভিজ্ঞতার কারণে বিএসসি এর নেতৃতের কাছে বৈশ্বিক নৌ বাণিজ্য সম্পর্ক, গ্রাহক/বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত অভিযোজন এবং প্রয়োজনীয় উদ্ভাবনে বিনিয়োগ সম্পর্কে ধারণা নাই বললে চলে, যার ফলে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। বিএসসি-এর নেতৃত্বে এই ধরনের অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে তারা সময়োপযোগী, সঠিক ও তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। তড়িৎ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া নৌ বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এর উপর নির্ভর করে নৌ বাণিজ্যের সফলতা বা ব্যর্থতা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা আসে নৌ বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা থেকে। দায়িত্ব নিয়ে বলা যায় বি এস সি এর বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে এর অভাব প্রকট।
এফএমএল-এর সাফল্য এবং বিএসসি-এর স্থবিরতা থেকে এটি স্পষ্ট যে, একটি প্রতিষ্ঠানের পেশাদার নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এফএমএল-এর নেতৃত্ব এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে ফ্লেক্সিবিলিটি এবং উদ্ভাবনের গুরুত্ব রয়েছে। ফলে, তারা দ্রুত পরিবর্তনশীল বাজারের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে প্রতিনিয়ত নতুন সাফল্য অর্জন করছে। বিএসসি-এর ক্ষেত্রে, এর নেতৃত্ব পেশাদার না হওয়ার কারণে ফলে নৌ বাণিজ্যের নতুন সুযোগগুলি দ্রুত গ্রহণ করতে পারে না।
ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের এই তুলনা থেকে নৌ বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো: পেশাদার নেতৃত্ব এবং অভিজ্ঞতা, ব্যবসায়িক সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। এফএমএল-এর সাফল্য নির্দেশ করে যে শিপিং খাতে পেশাদারিত্ব ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব শুধু কোম্পানিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম নয়, গ্রাহক-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্নতিরও সহায়ক। অন্যদিকে, বিএসসি-এর স্থবিরতা থেকে বোঝা যায় যে, শিপিং খাতে অভিজ্ঞতার অভাব নৌ বাণিজ্য প্রসারে প্রধান বাধা।
বিএসসি-এর সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে হলে এটি বাণিজ্যিক-কেন্দ্রিক নেতৃত্ব পদ্ধতি গ্রহণ করা এবং শিপিং ব্যবস্থাপনায় পেশাগত অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের পরিবর্তন না আনলে প্রতিষ্ঠানটি স্থবির অবস্থায় আটকে থাকার ঝুঁকিতে থাকবে।
এবার আসা যাক বাংলাদেশী প্রাইভেট কোম্পানি এস আর শিপিং সম্পর্কে। সম্পূর্ণ পেশাজীবী দ্বারা পরিচালিত কোম্পানিটি ধীরে ধীরে অনেক দূর এগিয়েছে। শুধু জাহাজের সংখ্যা দিয়ে নয়, তাদের জাহাজ পরিচালনাও আন্তর্জাতিক মানের। এই কোম্পানির মূল দায়িত্বে আছেন একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।

 

লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট। বর্তমানে কানাডার একটি অফশোর কোম্পানিতে মেরিন অপারেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে কর্মরত।

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট