চট্টগ্রাম বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৪

রেমিট্যান্স বাড়াতে আরো উদ্যোগ চাই

মো. দিদারুল আলম

৬ অক্টোবর, ২০২৪ | ২:১৪ অপরাহ্ণ

দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে জুলাই মাসে রেমিট্যান্স কম এসেছে। তবে খুশির খবর, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ২১ দিনে দেশে বৈধ পথে ১৬৩ কোটি ৪২ লাখ (১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৯ হাজার ৬১১ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)।

 

২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে ১৯১ কোটি ৩৫ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। যা আগের ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৩৩ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৯২ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা। দেশীয় মুদ্রার যার পরিমাণ ২ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। রেমিট্যান্সের এ অংক এ যাবতকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

 

২০২৩ সালের জুলাইয়ে সরকারি সংস্থা ব্যুরা অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি) জানিয়েয়েছিল, বাংলাদেশের ১ কোটি ৫৫ লাখ অভিবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে ও কর্মরত রয়েছে। ২০২৪ সালে এ সংখ্যাটি আরো দশ লক্ষের মতো বাড়তে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ অভিবাসীদের কর্মসংস্থান না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কতখানি ভয়াবহ বেকারত্ব সমস্যায় বিপর্যস্ত হতো সেটা কল্পনা করতেই ভয় লাগে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বাংলাদেশকে যে ‘আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস’ অভিহিত করা হয়েছিল, তার প্রধান কারণই ছিল ওই সময়ের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল এবং দেশটি ওই বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থান করতে পারবে না বলে উন্নয়ন-চিন্তকরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন। তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

 

আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি যে এই পর্যায়ে এসেছে, তা সর্বাগ্রে প্রবাসীদের অবদান প্রথম দিকে থাকবে। এই জনসংখ্যায় এখন জনসম্পদে রুপান্তরিত হচ্ছে। এই ধরিত্রীর বিভিন্ন দেশে অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জিত অর্থ-রেমিট্যান্স যাঁরা দেশে পাঠাচ্ছে, তাদের দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তাদের প্রতি বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতা-অভিযোগের অন্ত নেই। দালালের দৌরাত্ম্য, পাসপোর্ট জটিলতা, কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ নতুন কোনো বিষয় না হলেও তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৃত্যুর পর প্রবাসীদের প্রতি অবহেলাও। প্রবাসীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু বৃদ্ধি পেলেও তা প্রতিরোধে বা ঘটনা তদন্তে উদ্যোগী নয় দূতাবাসগুলো। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স প্রেরণকারী মধ্যপ্রচ্যের শ্রমিকরা দেশে অধিকতর নিগৃহীত হচ্ছেন। বিমানবন্দরে নেমেই তারা অরাজক আচরণ-ভোগান্তিতে নিপতিত হয়।

 

ড. ইউনুস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ার পর থেকে বিমান বন্দরের পরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে। যেমন বিনামূল্যে টেলিফোন করার ব্যবস্থা করেছেন, ফ্রি-ওয়াফাই দিয়েছেন। এর ফলে প্রবাসীরা দেশে ফিরে পরিবারকে সহজে জানাতে পারছে যে, আমরা নিরাপদে পৌঁছেছে। এছাড়াও তিনি এয়ারপোর্টে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঠিক আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন এটা প্রবাসীদের জন্য তথাদেশবাসীর জন্য অনেক বড় একটা আশার আলো। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই ঘোষণা দিয়েছেন যে, কোনো লাগেজ হারিয়ে গেলে বা ভেঙে গেলে, এয়ারপোর্ট কর্মীদের বেতন কাটা হবে। এই ব্যবস্থা প্রবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, আমাদের কষ্টের ফলাফলের সুরক্ষা দেবে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো প্রবাসীরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন। নিশ্চিত করতে হবে যে, এই নির্দেশনাগুলো কঠোরভাবে পালন করা হয়। প্রবাসীরা যেন আর কোনো ধরনের অবমাননার শিকার না হয়, তাঁদের যেন যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়।

 

রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। বিশেষ কাজে দক্ষতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার শ্রমিকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। এ প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে সনদ প্রদান করবে যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে। আমাদের কর্মীদের কর্মদক্ষতার শ্রেণি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অদক্ষ বা কম দক্ষ কর্মীদের সংখ্যা মোট সংখ্যার ৭০ শতাংশের বেশি, দক্ষ শ্রেণি ২২-২৫ শতাংশের মধ্যে, আধা দক্ষ ৫ শতাংশের নিচে এবং পেশাজীবী শ্রেণি ১ শতাংশেরও অনেক নিচে। যদি দক্ষ কর্মী সংখ্যার পরিমাণ ৭০ শতাংশের কাছাকাছিও নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশের বার্ষিক রেমিট্যান্স বর্তমানের চেয়ে তিন-চার গুণ বৃদ্ধি পাবে। দেশের বিদ্যমান অবকাঠামো এবং প্রশাসনিক নিয়ম-নীতি বিবেচনায় এ কাজটি রাতারাতি করা সম্ভবও হবে না। এজন্য একটি পাঁচ থেকে ১০ বছর মেয়াদি কর্মিবান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণ করে এগোতে হবে। বিদেশে কর্মী প্রেরণে নিযুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এই ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সত্যি বলতে, সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিভঙ্গি এবং পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

 

বাংলাদেশে প্রবাসীদের হয়রানির শিকার হয় শুরু থেকেই। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে একজন লোক মধ্যপ্রাচ্যর যে কোনো দেশে যেতে বাংলাদেশের তুলনায় ৪ থেকে ৫ গুণ টাকা কম লাগে। বেসরকারি এজেন্সিদের দৌরাত্ম্য থেকেই উদ্ভব হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি। বিমানের টিকিটের মূল্যবৃদ্ধিসহ সঠিক সময়ে বিদেশে এসে নির্ধারিত কাজ না পাওয়া। বাংলাদেশ মিশনগুলোর গাফিলতি, সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বিদেশে এসেও হয়রানির শিকার হয়, নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থ হয়। প্রবাসীদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূরীকরণের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা এবং সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন। প্রবাসী এবং তাদের পরিবারের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য প্রবাসীরা বাংলাদেশ অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের কাজ করতে হবে। কোনো প্রবাসী যদি কোনো কারণে বিদেশ থেকে চলে আসতে হলে তার জন্য দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। প্রবাসীদের যত বেশি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে ততবেশি রেমিট্যান্স আসবে দেশে। আর রেমিট্যান্স প্রবাহ সচল থাকলে দেশের অর্থনীতির দ্রæত উন্নতি ঘটবে। এছাড়া প্রবাস আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে অর্থপাচার রোধ, হুন্ডির মাধ্যমে বা অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করার কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং একই সঙ্গে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো পদ্ধতি আরো সহজ, আকর্ষণীয় এবং উৎসাহব্যঞ্জক করতে হবে।

 

বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে আরও তৎপরতা দেখাতে হবে। তাদের নতুন নতুন কর্মের খোঁজ নিতে হবে। প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। হুন্ডিকে চতুরভাবে উৎসাহিত করার কাজে যুক্ত কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক বা তাদের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানি আয় দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ বাজারে সব উপায়ে ডলারের জোগান বাড়াতে হবে আর বিনিময় হারেও আনতে হবে স্থিতিশীলতা। প্রবাসী ভাইদের অনুরোধ করব, বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠান। সরকারকে কঠোর হস্তে সরকারকে হুন্ডি ব্যবসা দমন করতে হবে। দেশের অর্থনীতি বাাঁচাতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি দেশের নীতিনির্ধারকদের উচিৎ প্রবাসীদের সম্মান দিয়ে কথা বলা।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলেজ-শিক্ষক।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট