বোয়ালখালীর মানচিত্র থেকে অনেকটা মুছে গেছে চরখিজিরপুরের ননাইয়ারমার ঘাট এলাকার তাঁতিপাড়া। সর্বনাশা খালের ভাঙনে কেড়ে নিয়েছে মানুষের ঘরবাড়ি ও জমিজমা। উদ্বাস্তু হয়েছে অনেক পরিবার। তাঁতিপাড়া ছাড়াও একই এলাকার আরও অনেক পরিবার উদ্বাস্তু হয়েছে।
গত শুক্রবার কথা হয় ওই এলাকার গৃহবধূ রোকেয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি বললেন, গত আগস্টের বন্যার প্রভাবে প্রবল জোয়ারে চোখে সামনে অন্তত তিন গন্ডা (৬ শতক) জমি খালে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙতে ভাঙতে তাদের পুকুরের অর্ধাংশ বিলীন হয়ে গেছে। তার দেবরের ঘর এখন হুমকির মুখে। তিনি বলেন, ১৫-২০ বছর ধরে খালের ভাঙন চলে আসছে। কাঁচা লবণ ও মালবোঝাই বড় নৌকা চলাচলের কারণে এক দশক ধরে ভাঙন তীব্র রূপ নেয়। শুধু ভোট আসলে ভাঙনরোধের আশ্বাস দেন রাজনৈতিক নেতারা। ভোটের পর তাদের আর দেখা মিলে না। স্থানীয়রা জানান, বোয়ালখালী খালের ভাঙন দীর্ঘদিনের। ভাঙনে বোয়ালখালী ও পটিয়া দুই উপজেলার অন্তত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কয়েকটি স্থানে সিসি ব্লক বসানো হলেও বেশির ভাগ এলাকা অরক্ষিত থাকায় ভাঙন তীব্র রূপ নেয়।
১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের পর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ-দুই সরকারের আমলে কর্ণফুলী নদী এবং নদী সংলগ্ন খালের ভাঙনরোধের আশ্বাস দিয়েছিল সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। ২০০৮ সালে বড় প্রকল্পও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তবে ২০১৩ সালে বোয়ালখালী ও রাউজান উপজেলার কর্ণফুলীর ভাঙনরোধে ৭২ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছিল। এরপর বছরের পর বছর শুধু আশ্বাসেই পেট ভরেছে ভাঙনকবলিত ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষদের। নদী-খালের তীব্র ভাঙনে কপাল পুড়ছে শুধু বোয়ালখালীবাসীর নয়। আনোয়ারা ও বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকায় সাগরের ভাঙন আরও ভয়াবহ। বর্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ-জলোচ্ছ্বাসে সাগরের ভাঙন ভয়াবহ রূপ নেয়। কেড়ে নেয় মানুষের ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্বল। দীর্ঘদিন ধরে মানুষ ভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে আসছেন। গত ২৭ মে একনেক সভায় বোয়ালখালী, আনোয়ারা ও বাঁশখালী উপজেলায় ভাঙনরোধে দুটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। দুটি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৯ কোটি টাকা। প্রকল্প অনুমোদন হলেও কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর অর্থ সংকটের কারণে মেগাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সংশয় দেখা দেয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এই দুই প্রকল্প নিয়ে ইতিমধ্যেই পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে দুটি সভা হয়েছে। সভায় শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রকল্প বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন। বোয়ালখালীর কর্ণফুলী নদী ও খালের ভাঙনরোধ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৪ কোটি টাকা। ৬ দশমিক ৪৭০ কিলোমিটার তীর প্রতিরক্ষা ছাড়াও বিভিন্ন খালের ভাঙনরোধে কাজ করা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (রাঙামাটি বিভাগ) নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা বলেন, ‘আশা করছি, চলতি বা আগামী মাসে প্রকল্পটি টেন্ডারে যেতে পারবে। তীব্র ভাঙনকবলিত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টেন্ডার আহ্বান করা হবে।’ পাউবো সূত্র জানায়, সাতটি মেগাপ্রকল্প নিয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থ সংকটের বিষয়ও আলোচনা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ কোড অনুমোদন দিলেই প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করা হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ পূর্বকোণকে বলেন, ‘ভাঙনের ভয়াবহ চিত্র দেখে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও শীর্ষ কর্মকর্তারা। অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ কোড প্রদানেরও আশ্বাস দিয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই প্রকল্পটি ঠিকাদার নিয়োগে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে।’
প্রকল্প দুটি মে মাসে একনেক সভায় পাস হওয়ায় চলতি অর্থ বছরে (২৪-২৫ সাল) বরাদ্দ রাখা হয়নি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার কথা বলেছেন একাধিক কর্মকর্তা। এছাড়াও চলমান প্রকল্প থেকে অর্থ সাশ্রয় করে প্রকল্পগুলো চালুর করার পরিকল্পনা রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের। প্রকল্প দুটি হচ্ছে বোয়ালখালী উপজেলার কর্ণফুলী নদী এবং সংযুক্ত খালসমূহের বিভিন্ন স্থানে ভাঙনরোধকল্পে তীর সংরক্ষণ প্রকল্প এবং বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলায় টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা (১ম পর্যায়) প্রকল্প।
প্রকল্প দুটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে আনোয়ারা ও বাঁশখালী উপজেলায় সাগর উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ভাঙন প্রতিরোধে প্রায় ৮৭৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে আনোয়ারা উপজেলায় ৩২০ কোটি টাকা এবং বাঁশখালী উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫৫ কোটি টাকা। বোয়ালখালী ভাঙনরোধ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২৭ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
পূর্বকোণ/ইব