চট্টগ্রাম বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্তন ক্যানসার ও চট্টগ্রাম ক্যানসার সেন্টার-হাসপাতাল

১ অক্টোবর, ২০২৪ | ৭:১৫ পূর্বাহ্ণ

অক্টোবর স্তন ক্যানসারের জন্য সচেতনতার মাস। সারাবিশ্বে এই মাসে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন মাসব্যাপী মহিলাদেরকে স্তন ক্যানসারের প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের ব্যাপারে অবহিত করে থাকে।

স্তন ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করতে পারলে এবং সঠিক নিয়মে চিকিৎসা পেলে শতভাগের কাছাকাছি ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধারণা করা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ থেকে ১৫ হাজার মহিলা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। কিন্তু এই সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ ক্যানসারের সঠিক সংখ্যা জানতে হলে একটি জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রি দরকার; যা আমাদের এখনও নেই। আমরা জানি যে, স্তন ক্যানসার মহিলাদের সবচেয়ে বেশি হয় এবং চট্টগ্রামে প্রতিবছর কতজন মহিলা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন তার সংখ্যাও আমাদের জানা নেই।

২০১৯ সালে আটটি বিভাগীয় শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনসহ আটটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ৮ হাজার ৯৬৮ কোটি ৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে অন্যতম ‘বিভাগীয় শহরে ক্যানসার হাসপাতাল স্থাপন’। এটি একটি ভালো প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। খাবারসহ নানা কারণে ক্যানসার রোগ বাড়ছে। তাই এর চিকিৎসাসেবা বৃদ্ধি জরুরি।

জানা যায়, বিভাগীয় মেডিকেল কলেজে দু’তলা বেসমেন্ট ও ১৫ তলা ফাউন্ডেশনসহ মোট ১৭ তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসার সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেটে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপন করা হবে।

এই প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে ১৫ তলা ক্যানসার সেন্টারের কাজ শুরু হয়েছে; তবে কবে নাগাদ শেষ হবে তা এখনও জানা যায়নি। শুনেছি এই প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে কোন ক্যানসার বিশেষজ্ঞকে দেওয়া হয়নি। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ঘনিষ্ঠ কেউ একজন ছিলেন পিডি (প্রজেক্ট ডাইরেকটর)। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে চট্টগ্রামের মানুষের জানার অধিকার আছে এই ক্যানসার সেন্টারের কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে এবং কখন জনগণ এই সেন্টার থেকে সেবা পাবে। চট্টগ্রামের যে সমস্ত পরিবারে ক্যানসার রোগী আছেন- আপনারা সবাই একতাবদ্ধ হয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। কারণ এই ক্যানসার সেন্টার জনগণের টাকায় বানানো হচ্ছে। একটি গুণগত মানের ক্যানসার সেন্টার আমাদের খুব দরকার। এখানে যাতে কোন দুর্নীতি না হয় সে ব্যাপারে আপনাদের সোচ্চার থাকা জরুরি।

বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামে ক্যানসারের চিকিৎসা খুবই সীমিত। টেকনাফ থেকে কুমিল্লার সীমানায় বসবাসরত অনেক নাগরিকের চিকিৎসার ভরসাস্থল হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও লোকবলের অপ্রতুলতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসারের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ক্যানসার তথা স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল। আজকের আলোচনায় আমি প্রধানত স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার পর্যায়ক্রমিক ধাপ এবং চট্টগ্রামে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কী ব্যবস্থা বিদ্যমান সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

বর্তমান পৃথিবীতে বেশিরভাগ দেশ ক্যানসারকে প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের প্রচলন করে থাকে। স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় টিউমার শনাক্ত করার গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি হচ্ছে ম্যামোগ্রাম।

ম্যামোগ্রাম মেশিন হলো বিশেষ ধরনের একটি এক্স-রে মেশিন যার মাধ্যমে স্তনের ছবি তোলা হয়। সেই ছবি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত রেডিওলজিস্ট (এক্স-রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার) পরীক্ষা করে বলতে পারেন স্তনে কোন টিউমারের অস্তিত্ব আছে কিনা। একটি ম্যামোগ্রাম মেশিনের দাম কোটি টাকার উপর হতে পারে। ম্যামোগ্রাম মেশিন দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি সাধারণ এবং অন্যটি টমোসিনথেসিস অথবা থ্রি-ডি ম্যামোগ্রাম মেশিন। থ্রি-ডি ম্যামোগ্রামে টিউমারের অস্তিত্ব শনাক্ত করা বেশি সহজ হয়। ম্যামোগ্রাম ছাড়াও এমআরআইয়ের সাহায্যে টিউমার শনাক্ত করা যায়। কিন্তু এমআরআইয়ে খরচ একটু বেশি হয়।

একজন মহিলার বয়স ৪৫ বছর হলে ম্যামোগ্রাম করানো জরুরি। যদি পরিবারে মা-বোনের স্তন ক্যানসার আগে হয়ে থাকে তাহলে ৪০ বছর বয়স থেকে ম্যামোগ্রাম প্রতিবছর করতে হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে একটি ফিল্মবেইজড ম্যামোগ্রাম আছে। কিন্তু ব্রেস্ট স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের জন্য কমপক্ষে ৪টি ডিজিটাল ম্যামোগ্রাম মেশিন প্রয়োজন। নির্মাণাধীন ক্যানসার সেন্টারে কয়টি ম্যামোগ্রাম মেশিন থাকবে আমার জানা নেই।

ম্যামোগ্রামে ক্যানসারের লক্ষণ দেখা গেলে সাথে সাথে আল্ট্রাসাউন্ড করে বায়োপসি করতে হয়। সাধারণত রেডিওলজিস্ট এই কাজটি করে থাকেন। তারপর বায়োপসি করা টিস্যু পাঠাতে হয় প্যাথলজি ল্যাবরেটরিতে। সেখানে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত প্যাথলজিস্ট পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিয়ে থাকেন।

বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে স্তন ক্যানসার সম্পূর্ণ রিপোর্টিং করার রিসোর্স বা সক্ষমতা নেই। এই রিপোর্টিংয়ের খরচ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা হতে পারে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে এবং স্তন ক্যানসারের স্টেজিংয়ের উপর ভিত্তি করে ব্রেস্ট সার্জন, মেডিকেল অনকোলজিস্ট ও রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট বিভিন্ন পর্যায়ে রোগীকে সেবা দিয়ে থাকেন। কারও ব্রেস্ট ক্যানসার হলে রোগ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে চিকিৎসা শেষ হতে ৬ মাস থেকে ১২ মাস সময় লাগতে পারে। এই পুরোটা সময় রোগীকে বারে বারে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে ভিজিট করতে হয়। কোন রোগীর কেমোথেরাপি লাগলে ৩ মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত প্রতি ৩ সপ্তাহ পর পর চিকিৎসা নিতে হয়। যদি কোন রোগীর রেডিয়েশন দরকার হয় তাহলে ৩ সপ্তাহ থেকে ৬ সপ্তাহ রেডিয়েশন দিতে হয়। লিনিয়ার এক্সেলেটর নামে মেশিনের সাহায্যে রেডিয়েশন দিতে হয়। বর্তমানে চট্টগ্রামে সরকারি হাসপাতালে কোন লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন নেই। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে একটি ও প্রাইভেট ক্লিনিকে একটি লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন আছে।

আশা করি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ক্যানসার সেন্টারে লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন অতিশীঘ্রই আসবে। এই মেশিন অত্যন্ত ব্যয়বহুল; একটি মেশিনের দাম ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা। পৃথিবীতে হাতেগোনা কয়েকটি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি এই মেশিন তৈরি করে থাকে। তবে প্রায় দেশের ক্যানসার সেন্টারে আমেরিকান ভেরিয়েন এবং ইউরোপিয়ান ইলেক্টা কোম্পানির লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে এই মেশিন ক্রয়ের ব্যাপারে কোন নীতিমালা আছে বলে আমার জানা নেই। আমার মতে এই ধরনের ক্যাপিটাল ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের নীতিমালায় পরিবর্তন দরকার। বাংলাদেশর লোকসংখ্যার অনুপাতে আমাদের দেশে কমপক্ষে ১৮০ থেকে ২০০টি লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন দরকার। এক্ষেত্রে মেশিনগুলো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে না কিনে সরাসরি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে কেনা উচিত বলে আমি মনে করি। এই মেশিনগুলো যখন কেনা হয়, এর সাথে প্যাকেজ হিসেবে বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং কম সময়ের মধ্যে বিভিন্ন পার্টস সাপ্লাই ও মেরামতের নিশ্চয়তাসহ কেনাটা সমীচিন। তা না হলে কেনার কিছুদিন পর মেশিন নষ্ট হলে মাসের পর মাস অকেজো পড়ে থাকে।

বর্তমানে ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রায় সবকটি লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন ঠিকমতো কাজ করছে না। যার ফলে অসংখ্য ক্যানসার রোগী রেডিয়েশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই মেশিনগুলোর ক্রয়প্রক্রিয়ার ত্রæটির কারণে পুরো জাতিকে এর মাশুল দিতে হচ্ছে।
দেশে প্রতিবছর ১৩ থেকে ১৫ হাজার স্তন ক্যানসারের রোগী শনাক্ত হয় বলে ধারণা করা হয়। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি বলে আমি মনে করি। এই বিশাল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা দেশে করা খুবই জরুরি।
কেমোথেরাপি ও ইমিউনোথেরাপি ওষুধের দামও অনেক বেশি, যা সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সরকারের মালিকানাধীন এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি কিছু বেসিক ক্যানসার নিরাময় ড্রাগস তৈরির পদক্ষেপ নিতে পারে। নির্মাণাধীন সরকারি ৮টি ক্যানসার হাসপাতালের প্রয়োজনীয় লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন এবং অন্যান্য মেশিন যেমন- সিটি সিমুলেটর, ব্রাকি থেরাপি মেশিন, প্ল্যানিং সফটওয়্যার ইত্যাদি যদি ঠিকমতো কেনা না হয় তাহলে ৮টি ক্যানসার সেন্টার শুধু বিল্ডিং হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং ক্যানসার রোগী ও তাদের পরিবারের কোন উপকারে আসবে না।
পৃথিবীর প্রায় দেশেই এমনকি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকায় মেডিকেল অনকোলজি (কেমোথেরাপি বিশেষজ্ঞ) এবং রেডিয়েশন অনকোলজি (রেডিয়েশন থেরাপি বিশেষজ্ঞ) সম্পূর্ণ আলাদা স্পেশালিটি। গত দশ বছরে আমাদের দেশেও মেডিকেল অনকোলজি আলাদা স্পেশালিটি হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। চট্টগ্রামে আলাদাভাবে মেডিকেল অনকোলজি সেবা আছে কিনা জানা নেই।

চিকিৎসার গুণগত মান ও রোগীর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ক্যানসার চিকিৎসার যথাযথ ফল পেতে হলে মেডিকেল অনকোলজি ও রেডিয়েশন অনকোলজি আলাদা আলাদা বিশেষজ্ঞের সাহায্যে করা অতীব জরুরি। অতীতে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা কম হওয়ায় একজন ডাক্তারকেই একইসাথে দুটি বিভাগের কাজ করতে হতো। আমার মনে হয় এই ‘গ্র্যান্ড ফাদার্স ক্লজ’কে ভিত্তি করে আগামীদিনের অনকোলজি সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স এন্ড সার্জন্সের অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করা জরুরি। একজন ডাক্তারকে যদি দুটি বিভাগের কাজ একসাথে করতে হয় তাহলে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার গুণগত মান বজায় থাকবে না এবং রোগীরা বিদেশমুখী হবে।

ক্যানসার চিকিৎসা যেহেতু ব্যয়বহুল, সে কারণে সরকারিভাবে এবং সকল নাগরিকের একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের মাসিক কন্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে একটি ‘জাতীয় ক্যানসার কেয়ার ফান্ড’ তৈরি করা দরকার। যার মাধ্যমে ক্যানসারের চিকিৎসা সবার জন্য সরকারের তরফ থেকে করা সম্ভব হতে পারে। আমরা সবাই যদি সম্মিলিতভাবে এ ব্যাপারে কাজ না করি তাহলে সরকারি ক্যানসার সেন্টারগুলো কেবল একটি ১৫ তলা অট্টালিকা হিসেবে শোভাবর্ধন করবে।

লেখক : ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন
রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ডালহাউসি ইউনিভার্সিটি,
সেইন্টজন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউ ব্রান্সউইক, কানাডা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট