Use Heart for Action- কর্মের জন্য হৃদয়কে ব্যবহার করুন। এই প্রতিপাদ্যে এই বছর ২৯ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। বিশ্ব হার্ট দিবসকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রোগ্রাম গ্রহণ করা হয়। আমরা এই দিবসটিতে যেভাবে সচেতনতার আলাপ করি বা বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি সেভাবে যদি সারা বছর নিয়ন্ত্রিত জীবন জীবনযাপন করতে পারতাম তা হলে এই হৃদরোগ অনেকাংশে আমরা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হতাম। হৃদরোগ সংক্রান্ত অনেক উপদেশ দেওয়া বা শোনার চেয়ে বাস্তব জীবনে বেশি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। কারণ আমাদের হাত পা চোখ কান দুটো করে হলেও আমাদের হৃদয় কিন্তু একটি। এটি একটি মাংস পিন্ড। এই মাংসপিন্ডটি যদি সুস্থ্য থাকে তাহলে আমাদের পুরো শরীরই সুস্থ্য থাকে। যেভাবে মানবতার মহান দূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, শরীরের মধ্যে এমন একটি মাংসপিন্ড আছে, যা সুস্থ্য থাকলে পুরো শরীর সুস্থ্য থাকে, যা অসুস্থ্য থাকলে পুরো শরীর অসুস্থ্য থাকে, এবং সেটা হচ্ছে হার্ট।
প্রতিদিন ১১৫,০০০ বারের বেশি হার্ট বিট করে। হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি কোষে রক্ত প্রবাহিত হয়। প্রতিদিন হার্ট প্রায় ২০০০ গ্যালন রক্ত পাম্প করে, মানে এটি প্রতি মিনিটে ১.৫ গ্যালন রক্ত পাম্প করে। হার্ট বা হৃদপিন্ড মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটির স্পন্দন যদি কখনো বন্ধ হয়ে যায় তাহলে জীবন প্রদীপটাই নিবে যাবে। হৃৎপিন্ডটি এমন এক পাম্পযন্ত্র যা মাংসপিন্ড দিয়ে তৈরী। হৃৎপিন্ডের মাংসপেশিকে রক্ত সরবরাহের জন্য রয়েছে বিশেষ রক্তনালী, যা করোনারী আর্টারী নামে পরিচিত। করোনারী আর্টারী ফ্যাট বা চর্বি জমে ব্লক হয়ে যায়। তখন হৃদপিন্ডের পেশীগুলোতে রক্ত সরবরাহের পরিমাণও কমে যায়। এতে করে রোগীর বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্টসহ শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। যদি আপনার হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে, তবে এর অর্থ হলো, আপনারও হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে। ধূমপান, জাঙ্ক ফুড এবং ব্যায়ামের অভাব এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে। এক সময় বয়স্করা হৃদরোগ ঝুঁকিতে থাকলেও বর্তমান ৫০ এর কম বয়সী মানুষ বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর অসংক্রামক রোগে যত মানুষ মারা যায় তার অর্ধেকই মারা যায় এই হৃদরোগে, যার সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর বিশ্বে ১৯ লক্ষ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে। আর বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লক্ষ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায় তামাকজনিত কারণে। প্রতি দুই মিনিটে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।
বর্তমানে হৃদরোগ বাংলাদেশে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। তাই এ রোগ প্রতিরোধে সবার আগে হৃদ-স্বাস্থ্যের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত হয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যে কোনো রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। হৃদরোগের ক্ষেত্রে তা বেশি প্রযোজ্য। আমাদের দেশে হৃদরোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রামের মানুষ। বাংলাদেশে প্রথম হার্টের অপারেশন হয়েছিল যার তিনি কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষ। কেননা এই এলাকায় মানুষ ভীষণ ভোজনরসিক। তারা বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রচুর পরিমাণে চর্বি জাতীয় খাবার আয়োজন করে। বিশেষ করে এই অঞ্চলের মানুষ মেজবানি গোশতের প্রতি বেশি আগ্রহী। যার ফলে আমাদের শরীরে কোলেস্টেরোলের পরিমাণ বাড়ছে, যাতে বাড়ছে হৃদরোগের ঝুঁকিও। আমরা সবসময় একটা কথা বলে থাকি, হৃদরোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। আমরা চাইলেই আমাদের জীবনকে হৃদরোগের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারি। তার জন্য আমাদের জীবন মানের পরিবর্তন আনতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম বাড়াতে। ধুমপাণ ও মাদক পরিহার করতে হবে। চর্বি, ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। রক্তে কোলেস্টেরল পরিমাণ বেড়ে গেলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের আশঙ্কা বেড়ে যায়। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে পারলে হৃদরোগের আশঙ্কা কমে। আবার কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার কম খেলেও রক্তে এর পরিমাণ কমে যায়। কিছু খাবার রয়েছে যেগুলো হৃৎপিন্ডের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো রক্ত সঞ্চালনকে ব্যাহত করে এবং জটিল শারীরিক সমস্যা তৈরি করে। লাল মাংসে কোলেস্টেরল বেশি থাকে। উদ্ভিদজাতীয় খাবার মানুষের জন্য উপকারী।
সরু রক্ত নালিতে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। ঝুঁকি এড়াতে আপনি কম খেতে পারেন, কলিজা, মগজ, হাড়ের নলা। কেননা এতে বেশি পরিমাণ কোলেস্টেরল থাকে। তা ছাড়াও বড় মাছের মাথা, মুরগীর চামড়া, হাসের চামড়া ও হাসের ডিমে বেশি কোলেস্টেরল থাকে, যা রক্তের লিপিড প্রোফাইল বাড়িয়ে দেয় (এলডিএল , কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগিøসারাইড)। একজন হৃদরোগীর দিনে ২০০ মিগ্রা-র বেশি কোলেস্টেরল গ্রহণ করা উচিত নয়। হংকং আর সিঙ্গাপুরের দুটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যত লোক হংকংয়ে মারা গেছে, তার অন্তত তিনগুণ বেশি মানুষ মারা গেছে সিঙ্গাপুরে। গবেষকদের মতে, এর একটি কারণ হলো, সিঙ্গাপুরের অধিবাসীদের খাবারে নারিকেল ও পাম তেল ব্যবহারের প্রবণতা। নারিকেল তেলের ৮৫ থেকে ৯০ ভাগই হলো স্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা হৃদরোগীদের জন্যে ক্ষতিকর। খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন বেড়ে যায় এবং রক্তচাপও বেড়ে যায়, ফলে হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে (খাবার পাতে) অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।
এতোক্ষণ আমরা হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে কতিপয় খাবার কম খাওয়া বা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছি, এবার বলবো কোন কোন খাবার খেয়ে আপনার স্বাস্থ্য বা হার্ট ভালো থাকবে। আপনাকে সুস্থ থাকতে হলে অবশ্যই বেশি বেশি মৌসুমী ফল/ শাকসবজি বেশি বেশি খেতে হবে। কেননা মৌসুমী শাক-সবজি, ফলমূলে রয়েছে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক। সৃষ্টিকর্তা মৌসুমী ফলফলাদি ও সবজির মধ্যে ঐ সময়ের ঐ এলাকার বিভিন্ন রোগবালাইয়ের প্রতিষেধক দিয়ে থাকেন। তাই মৌসুমী ফলফলাদি বেশি বেশি খেতে হবে। আঁশ আছে এরকম সবজির মধ্যে রয়েছে শিম ও মটরশুঁটি জাতীয় সবজি, কলাই ও ডাল জাতীয় শস্য এবং ফলমূল। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলছেন, শেকড় জাতীয় সবজি খোসাসহ রান্না করলে সেগুলো থেকেও প্রচুর আঁশ পাওয়া যায়। এছাড়াও তারা হোলগ্রেইন আটার রুটি এবং বাদামী চাল ও ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খাবেন। যেসব খাবারে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ বেশি থাকে সেগুলো আমাদেরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এসব খাবার হৃদরোগের ঝুঁকিও কমিয়ে দেয়। ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়ামের মতো খনিজ উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করে। হৃদরোগের যেসব কারণ আছে সেগুলো ঠেকাতেও এসব খনিজ ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। অনেক খাদ্যবিশেষজ্ঞ মনে করেন, স্বাস্থ্যকর ও ভারসাম্যপূর্ণ ডায়েটের মাধ্যমেই এসব ভিটামিন ও খনিজ পাওয়া সম্ভব। মাছ, দুগ্ধজাত খাবার ও হোলগ্রেইনে পাওয়া যায় ভিটামিন বি। কলা, আলু এবং মাছে পটাশিয়াম। দুগ্ধজাত খাবার ও সবুজ পাতার সবজি থেকে পাওয়া যায় ক্যালসিয়াম। এছাড়াও আপনার খাদ্যতালিকায় যোগ করতে পারেন প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা.) এর পছন্দের ১২টি খাবার। যার মধ্যে রয়েছে বার্লি, খেজুর, ডুমুর, আঙ্গুর, মধু, তরমুজ, দুধ, মাশরুম, অলিভ অয়েল, ডালিম-বেদানা, ভিনেগার। এ খাবারগুলো আপনাকে সুস্থ রাখবে।
খাদ্যবিজ্ঞানীগণ খাবারকে দুইভাগে ভাগ করেছেন, জীবন্ত খাবার ও মৃত খাবার। প্রতিদিন জীবন্ত খাবার খান। জীবন্ত খাবারে থাকে ফাইটামিন, যা আমাদেরকে কর্মচঞ্চল রাখে। রঙ্গিন খাবারে বিভিন্ন রকম ফাইঢামিন থাকে। যেমন গাজর, বীট, পাকা ও কাচা রঙ্গিন ফল ও সবজি। মনস্তাত্তিক চাপ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি দ্বিগুণ করতে পারে। ব্যায়াম, মেডিটেশন এবং পর্যাপ্ত মানের ঘুম স্ট্রেস লেভেল কমাতে সাহায্য করে। স্ট্রেস দ্বারা আমাদের শরীর ও হার্টে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। তাই স্ট্রেসমুক্ত থাকুন, হার্টকে সুস্থ রাখুন ও নিজের শরীরকে সুস্থ রাখুন। হৃদরোগ প্রতিরোধে খাদ্যভাস পরিবর্তনের পাশপাশি আমাদেরকে কর্ম উদ্যোগ বাড়াতে হবে। কায়িক পরিশ্রম না করে শুধু খাদ্যাভাস পরিবর্তন করলে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা যাবেনা। হৃদরোগের চিকিৎসার চেয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধ উত্তম এবং এক্ষেত্রে শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপ‚র্ণ আমাদের যে কোনো শারীরিক নড়াচড়া যেটাতে দেহের ঐচ্ছিক পেশী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং পেশীর এই কাজের জন্য শক্তির ব্যয় ঘটে সেটিই শারীরিক পরিশ্রম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হলো কিশোর বয়সে বিশেষ করে ৫-১৭ বছর বয়স প্রতিদিন প্রায় এক ঘণ্টা ভালোভাবে শারীরিক পরিশ্রম করা দরকার। বিশেষ করে ওই বয়সে পেশী ও হাড়কে শক্তিশালী করে এমন কোন ব্যায়াম বা শরীরচর্চা সপ্তাহে অন্তত তিন বার করা উচিত। এক্ষেত্রে খেলাধুলা ভালো ভ‚মিকা পালন করে। আমাদের দেশে একসময় হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও অপ্রতুল হলেও বর্তমানে স্বল্পখরচে এ রোগের আধুনিক চিকিৎসা এখন দেশেই হচ্ছে। হৃদরোগের চিকিৎসাকে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জাতীয়ভাবে কর্মকৌশল তৈরি করা উচিত। আমাদের সুস্থ্য হৃদয় একটি সফল, স্বাস্থ্যকর এবং সুখী জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য। আসুন আমরা হৃদয় দিয়ে হৃদয় জয় করি, হৃদয় দিয়ে আমাদের সকল কর্ম তৎপরতা বাস্তবায়ন করি।
নিজের হার্টকে সর্বোত্তম ব্যবহার করুন। ভিন্নভাবে চিন্তা করার জন্য, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য, সাহসের সাথে কাজ করতে ও অন্যদের সাহায্য করতেও হৃদয়কে ব্যবহার করুন। হৃদয় হল একমাত্র অঙ্গ, যা আপনি শুনতে এবং অনুভব করতে পারেন। এটি জীবনের প্রথম এবং শেষ স্পন্দন। আমরা চাই এসব বার্তাগুলি যতটা সম্ভব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যায়, যাতে প্রতিটি মানুষ হার্ট ও রক্তনালীর সুস্বাস্থ্য অর্জনে সহায়তা করা যায়।
লেখক : চীফ কার্ডিওভাসকুলার সার্জন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল।
পূর্বকোণ/এএইচ